ব্যাংক রান - কি, কেন, কীভাবে?

491
article image

ব্যাংক রান হচ্ছে এমন একটি ঘটনা যেখানে কোনো ব্যাংকের বেশিরভাগ ডিপোজিটর একসাথে ব্যাংক থেকে নিজেদের টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন এবং বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের চাহিদাপূরণ করতে না পেরে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেক সময় গুজব বা ব্যাংক দ্বারা নেয়া কোনো ভুল পদক্ষেপের কারণে এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

Key Points

  • মানুষ যখন দেখে যে অন্য কেউ ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে নিচ্ছে, তখন সে নিজের অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য নিজের টাকা’ও তুলে নেয়ার চেষ্টা করে।
  • ব্যাংক রানের বাজে প্রভাব শুধু ব্যাক্তিজীবন পর্যন্ত’ই সীমাবদ্ধ নয়, বরং, এটি পুরো অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমস্যার সূচনা করতে পারে।
  • যখন অর্থনীতিতে বেকারত্ব, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মন্দার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন ডিপোজিটররা ব্যাংকে রাখা নিজেদের সঞ্চয় সম্পর্কে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
  • একটি ব্যাংক আর্থিকভাবে ব্যর্থ হলে তা অন্যান্য ব্যাংকগুলোর উপরেও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে, যদিও তারা আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে থেকে থাকে। এটাকে অনেক সময় কন্টাজিয়ন রিস্ক বলা হয়।

ভূমিকা

ফাইন্যান্স জগতে ব্যাংক রানের মতো ভয়াবহ ব্যাপার খুব কমই আছে। ইতিহাস পড়লে বার বার এই ঘটনার আবির্ভাব দেখা যায়, পাশাপাশি দেখা যায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ডিপোজিটরদের ভয়ার্ত চেহারা, যারা নিজেদের শেষ সম্বলটুকু ব্যাংক থেকে তুলে নেয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। কালের আবর্তনে এখন ব্যাংক রানের মতো ঘটনা খুব কমে গেলেও, অতীতে ব্যাংক রানের কারণে বহু মানুষকে নিজেদের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। আজকের লেখায় আমরা ব্যাংক রান কী, ব্যাংক রানের ইতিহাস ও এর কারণগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

ব্যাংক রান কী?

ব্যাংক রান হচ্ছে মূলত একটি আর্থিক ঘটনা, যেখানে একটি ব্যাংকের বিপুল সংখ্যক ডিপোজিটর একসাথে নিজেদের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এর পেছনে ভয়, অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকের কার্যকারিতার উপর কম আত্মবিশ্বাস দায়ী। এই ধরণের ঘটনার পেছনে সাধারণত গুজব, মিথ্যা রিপোর্ট ও ব্যাংকের বিশ্বাসঘাতকতা কারণ হিসেবে কাজ করে।

ব্যাংক রানের মতো ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে যায়। কারণ, মানুষ যখন দেখে যে অন্য কেউ ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে নিচ্ছে, তখন সে নিজের অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য নিজের টাকা’ও তুলে নেয়ার চেষ্টা করে। আবার এই দুইজনকে দেখে অন্যরা’ও ইনফ্লুয়েন্সড হতে পারে। তাই কিছু বুঝে উঠার আগেই ডোমিনো ইফেক্টের মতো ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়।

আবার অনেকসময় দেখা যায় যে ব্যাংকের কোনো খারাপ সিদ্ধান্ত যেমন - ভুল মানুষদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দেয়ার কারণে ব্যাংকের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে উঠতে পারে। তখন’ও ব্যাংক রানের মতো ঘটনা ঘটে।

ব্যাংক রানের ইতিহাস

ব্যাংক ব্যবস্থার শুরু থেকে ব্যাংক রানের মতো ঘটনার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে মানুষ যখন স্বর্ণকার ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছে অর্থ জমা রাখতো, তখন এই স্বর্ণকার ও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করার আশায় প্রয়োজনের বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে অন্যদের দিয়ে দিতো। ফলে গ্রাহকরা অর্থ তুলে নিতে চাইলে এরা গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে পারতেন না।

মূলত স্বচ্ছতার অভাব ও ব্যাংকিং সিস্টেমে ত্রুটির কারণেই ব্যাংক রানের মতো ঘটনা ঘটতো। এই সমস্যা উনিশ শতক পর্যন্ত’ও ব্যাংক ব্যবস্থায় দেখা যায়।

১৯০৭ সালে এমনই একটি প্যানিকের ঘটনার অনেকগুলো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ঘটনার ফলেই পরবর্তী সময়ে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দ্যেগ গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে আমেরিকার ব্যাংকিং সেক্টর ফেডারেল রিজার্ভ রেগুলেট করা শুরু করে এবং ব্যাংক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে।

কিছু স্পেসিফিক ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখার মাধ্যমে আমরা ব্যাংক রানের ইতিহাস সম্পর্কে আরো একটু গভীর ধারণা পেতে পারি।

দ্য গ্রেইট ডিপ্রেশন (১৯২৯ - ১৯৩৩)

মহামন্দার এই সময়টি ছিল পুরো বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম বাজে সময়। এই সময়ে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যায়, সম্পদের মূল অনেক কমে যায় এবং অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যায়। যার ফলে ব্যাংক রানের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মূলত প্যানিক থেকেই মানুষ ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিতে শুরু করে।

শুধু ১৯৩০ সালেই আমেরিকায় ১৩৫০টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ১৯৩১ সালের মাঝে এই সংখ্যা ২৩০০ ছাড়িয়ে যায়। কোটি কোটি আমেরিকানদের সারাজীবনের সঞ্চয় এইসব ব্যাংকের সাথে হারিয়ে যায় এবং শুরু হয় দশকব্যাপি আর্থিক বিপর্যয়ের।

আর্জেন্টাইন ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস (২০০১)

ব্যাংক রানের ভয়াবহতা জানতে সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টাইন ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের কথা বলা যায়। ব্যাংক রান কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে তার’ও আদর্শ উদাহরণ এটি। মূলত অর্থনৈরিক অস্থিতিশীলতা ও হাইপার-ইনফ্লেশনের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যায়।

তাই, যখন আর্জেন্টাইন পেসো’র (আর্জেন্টিনার মুদ্রা) ডিভ্যালুয়েশন সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পরে, তখন প্রচুর পরিমাণ মানুষ আর্জেন্টাইন পেসো’কে ডলারে পরিবর্তন করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কারণ ডলার ছিল বেশ স্ট্যাবল একটি কারেন্সি, অন্যদিকে পেসো’র ডিভ্যালুয়েট করা হলে মানুষের হাতে থাকা পেসো’র আসল মান কমে যেতো। যার ফলে একটি বিশাল প্যানিকের সৃষ্টি হয়।

সমস্যা সামলানোর জন্য আর্জেন্টাইন সরকার ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে পারার উপর লিমিট বসিয়ে দেয় এবং প্রচুর পরিমাণ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ফরেন রিজার্ভ রক্ষা করা। যদি’ও এর ফলে জনগণের রাগ আরো বেড়ে যায় এবং অর্থনীতি থেকে তাদের বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে যায়।

ফলস্বরুপ, আর্জেন্টাইন পেসো’র অবমূল্যায়ন করা হয় এবং ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে আর্জেন্টিনা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।

দ্য গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস (২০০৭ - ২০০৮)

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ওয়েল-ডকুমেন্টেড ব্যাংক রান ঘটে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের সময়। মূলত আমেরিকার হাউজিং বাবল বার্স্ট হওয়ার সাথে সম্পর্কিত হলেও এর প্রভাব পরেছিল সারা বিশ্বজুড়ে। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যাংক রানের মতো ডিপোজিটররা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার জন্য লাইন ধরেননি। বরং, এই ব্যাংক রানের চিত্র ছিল কিছুটা ভিন্ন।

ক্রাইসিস চলাকালীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লিক্যুইডিটি ক্রাইসিসের সম্মুখীন হয়। যেহেতু মন্দা শুরু হয়েছে, তাই বিনিয়োগকারীরা এইসব ব্যাংক থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে শুরু করেন। যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ পাচ্ছিল না, তাই তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে, শুরু হয় একটি ডমিনো ইফেক্টের এবং প্রচুর পরিমাণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এই কারণেই লেহমান ব্রাদার্সের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানের পতন হয়, যা ক্রাইসিসের একটি ডিফাইনিং মোমেন্ট ছিল।

দ্য ইউরোপিয়ান ডেট ক্রাইসিস (২০১০ - ২০১২)

ব্যাংক রানের আরেকটি মডার্ন উদাহরণ হচ্ছে ২০১০ সালের ইউরোপিয়ান ঋণ সংকট। গ্রিস, স্পেইন ও ইতালীর মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আরো কিছু দেশ বাড়তে থাকা ঋণ ও আর্থিকের সংকটের সম্মুখীন হয়। এই ধরণের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ব্যাংক ব্যবস্থার উপর বড় প্রভাব ফেলেছিল।

অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখে ডিপোজিটররা নিজেদের সঞ্চয়ের অবমূল্যায়নের কথা ভেবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেন এবং এতে করে ব্যাংক রান শুরু হয়। ফলস্বরুপ, সরকার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এখানে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তারা বিভিন্ন বেইলআউট প্যাকেজ অফার করার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা

ব্যাংক রানের এই ইতিহাসগুলো তুলে ধরে যে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর সাধারণ জনগণের কনফিডেন্স ও ট্রাস্ট থাকা কতোটা জরুরি। আবার এটাও বোঝা যায় যে কিভাবে সরকারের পরিস্থিতি সামলানোর ব্যর্থতা ও বাজে সিদ্ধান্ত ব্যাংক রানের মতো ঘটনাকে অবধারিত করে তুলতে পারে। ব্যাংক রানের বাজে প্রভাব শুধু ব্যাক্তিজীবন পর্যন্ত’ই সীমাবদ্ধ নয়, বরং, এটি পুরো অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমস্যার সূচনা করতে পারে।

আবার মডার্ন ব্যাংক রানের উদাহরণগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারি যে বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক কতোটা একে-অপরের সাথে কানেক্টেড। এখন ব্যাংক ব্যবস্থায় জটিলতা এবং বিশ্বাসের অভাব খুব দ্রুত ব্যাংক রান শুরু করতে পারে। আবার বিশ্বের একপার্শে ব্যাংক রান দেখা দিলে তার প্রভাব বিশ্বের অন্যপাশে’ও দেখা যায়।

এই ধরণের সমস্যা মোকাবিলায় এখন অনেক রেগুলেটরি পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে করে ভবিষ্যতে ব্যাংক রানের মতো ঘটনা আটকানো যায়। এখনকার সময়ে ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স পেতে অনেক ধরণের রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করে আসতে হয়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমাগত এইসব ব্যাংকে নজরদারির আওতায় রাখে যাতে করে গ্রাহকদের সঞ্চয় রক্ষা করা যায়।

ব্যাংক রান কেনো ঘটে?

ব্যাংক রান কোনো র‍্যান্ডম ইভেন্ট নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু ফ্যাক্টর ও ঘটনার চেইন রিয়েকশন হিসেবে ব্যাংক রানের মতো ঘটনা ঘটে। এই সেকশনে আমরা ব্যাংক রানের পেছনের কিছু কারণ সম্পর্কে জানবো।

১। পাবলিক পারসেপশান এবং ট্রাস্ট

যখন ডিপোজিটররা ব্যাংকের স্থিতিশীলতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে সাধারণত তখন ব্যাংক রানের মতো ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন কারণে ব্যাংকের উপর থেকে গ্রাহকের বিশ্বাস সরে যেতে পারে, যেমন - কোনো নিউজ রিপোর্ট, গুজব, ব্যাংকের আর্থিক বিপর্যয় ইত্যাদি।

আবার মানুষের ইমোশন ব্যাংক রানে গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে। মানুষের মনের ভয় এবং প্যানিক খুব দ্রুত একজনের কাছে থেকে অন্যজনের কাছে ছড়িয়ে পরতে পারে, এতে করে সবাই মনে করে যে তাদের অর্থ ঝুঁকিতে আছে। এতে করে একজনকে ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাতে দেখে সবাই ব্যাংক থেকে নিজদের অর্থ তুলে নিতে চায়।

২। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

অনেক সময় বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংক রানের দেখা মিলে। যখন অর্থনীতিতে বেকারত্ব, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মন্দার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন ডিপোজিটররা ব্যাংকে রাখা নিজেদের সঞ্চয় সম্পর্কে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।

আবার যদি কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়, আর ডিপোজিটররা সেই সম্পর্কে জানতে পারেন, তাহলে ব্যাংক রানের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আবার ব্যাংকের শেয়ারের দাম যদি কমতে থাকে বা ব্যাংকের অনেক টাকা লস হতে থাকে, তখন’ও ডিপোজিটররা নিজেদের টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন।

৩। বিশ্বাসের প্রভাব

পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা টিকে আছে বিশ্বাসের উপর। মানুষ বিশ্বাস করে যে, যখন তারা কোনো ব্যাংকে নিজেদের অর্থ ডিপোজিট হিসেবে জমা রাখে, তখন সেই অর্থ নিরাপদ থাকবে। যখন এই বিশ্বাস ভেঙে যায়, তখন ব্যাংক রান শুরু হয়।

অতীতে বার বার বিভিন্ন কারণে প্রচুর পরিমাণ ডিপোজিটরদের নিজেদের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। তাই যদিও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে, তবে অল্প কোনো সমস্যাতেই মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়, কারণ দেরি করলে তার সর্বস্ব’ও হারাতে হতে পারে।

৪। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তি যুগে, যেকোনো তথ্য অনেক দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌছে যায়। তাই অন্যরা কি করছে তা আমরা খুব দ্রুতই জানতে পারি। এতে করে মানুষ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে অন্যদের কর্মকান্ড দ্বারা খুব সহজেই প্রভাবিত হয়। ফলে ছোট ছোট ঘটনা ব্যাংক রানের মতো বড় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

৫। সাইকোলজিকাল ফ্যাক্টর

বেশিরভাগ সময়ই হার্ড মেন্টালিটি’র (Herd Mentality) কারণে ব্যাংক রানের মতো ঘটনা শুরু হয়। যেখানে মানুষ নিজের কি করা উচিত, সেই সম্পর্কে কিছু না ভেবে, অন্যরা যা করছে তা করা শুরু করে। আবার অনেকসময় কনফার্মেশন বায়াসের শিকার হয়ে’ও মানুষ এই ধরণের কাজ করে।

ব্যাংক রান প্রেডিক্ট করা ও প্রতিরোধ করার জন্য এই প্রতিটি কারণ সম্পর্কে জানা এবং বোঝা প্রয়োজন। আবার এগুলো জানলে আমরা নিজেরা’ও বুঝতে পারবো যে ব্যাংক রানের মতো পরিস্থিতি আসলে কিভাবে হ্যান্ডেল করা উচিত।

ডমিনো ইফেক্টঃ কিভাবে ব্যাংক রান পুরো অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে যে ব্যাংক রানের শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঘটনা, তবে বাস্তবে ব্যাংক রানের প্রভাব পুরো অর্থনীতির উপর পরতে পারে। চলুন জেনে নেয়া যাক যে একটি একক ব্যাংক রান কিভাবে একটি ডমিনো ইফেক্ট তৈরি করতে পারে।

১। সিস্টেমেটিক রিস্ক

একটি ব্যাংক আর্থিকভাবে ব্যর্থ হলে তা অন্যান্য ব্যাংকগুলোর উপরেও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে, যদিও তারা আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে থেকে থাকে। এটাকে অনেক সময় কন্টাজিয়ন রিস্ক বলা হয়। এরপর ফলে নিজের ব্যাংকে কোনো সমস্যা না হলেও, অন্য ব্যাংকের সমস্যা দেখে গ্রাহক নিজের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন।

আধুনিক অর্থব্যবস্থা অনেক বেশি কানেক্টেড। এখানে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংককে ঋণ দেয়, একই ধরণের সম্পদে বিনিয়োগ করে এবং একই ধরণের সুবিধা প্রদান করে। তাই একটি ব্যাংক সমস্যায় পরলে তা অন্যান্য ব্যাংকগুলোকেও এফেক্ট করতে পারে।

২। ইকোনমিক প্রভাব

ব্যাংক রানের মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মতো ইফেক্ট অর্থনীতির উপর পরে।

আবার গ্রাহকের ডিমান্ড পূরণ করার জন্য ব্যাংকগুলো অনেক কম দামে সম্পদ বিক্রয় করে দিতে হতে পারে। ফলে ব্যাংকের লোকসান আরো বেড়ে যায়।

৩। সরকারের হস্তক্ষেপ

যখন কোনো ব্যাংক রানের ফলে পুরো অর্থনীতি হুমকির মুখে পরে, তখন সরকার বেইলআউট অফার করার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে। এইসব বেইলআইট প্যাকেজ অনেক কন্ট্রোভার্শাল হয় এবং দেশের অনেক টাকা এই বেইলআউটে খরচ হয়ে যায়।

আবার ব্যাংকগুলো যেহেতু জানেই যে ব্যাংক রানের শিকার হলে সরকার তাদের বেইলআউট প্যাকেজ অফার করবে, তাই তারা অত্যাধিক ঝুঁকি নিতে পারে। ফলে বেইলআউট প্যাকেজের মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

৪। বিশ্বাস হারানো

ব্যাংক রানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যাওয়া। যখন ডিপোজিটররা ব্যাংক রান দেখতে পায়, তখন তারা আরো বেশি সাবধান হয়ে ওঠে এবং টাকা ব্যাংকে রাখতে চায় না। এর ফলে অর্থনীতিতে টাকার সার্কুলেশন কমে যায়, ইনভেস্টমেন্ট কমে যায় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

ব্যাংক রান প্রতিরোধ

সরকার এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ব্যাংক রান প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই সেকশনে আমরা সেই স্ট্র্যাটেজিগুলো সম্পর্কেই জানবো।

১। ডিপোজিট ইন্সুরেন্স

ডিপোজিট ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে ডিপোজিটরদের এই শিওরিটি দেয়া হয় যে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলেও তাদের ডিপোজিটের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত তারা পাবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের উপর ডিপোজিটরদের বিশ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশে ডিপোজিট ইন্সুরেন্সের পরিমাণ ১,০০,০০০ টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংক যদি দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আপনি ফেরত পাবেন।

২। ব্যাংকিং রেগুলেশন

ব্যাংকগুলো যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যাপিটাল মেইনটেইন করে, তা রেগুলেটরি অথোরিটিগুলোর পক্ষ থেকে এনশিওর করা হয়। এতে করে অর্থনৈতিক মন্দার সময় এই ক্যাপিটাল একটি বাফার হিসেবে কাজ করবে।

আবার ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত স্ট্রেস টেস্টিং - এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হয় যে অর্থনৈতিক মন্দার সময় ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারবে কি না।

আবার রেগুলেটরি অথোরিটিগুলো প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোর উপর নজরদারি করে। এতে করে কোনো ব্যাংকের আর্থিক বিপর্যয় শুরু হওয়ার আগেই তা প্রেডিক্ট ও প্রতিরোধ করা যায়।

৩। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা

ব্যাংক রানের মতো পরিস্থিত এড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো জন্য Lender of Last Resort হিসেবে কাজ করে। আবার কোনো ব্যাংক লিক্যুইডিটি ক্রাইসিসে পরলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইমার্জেন্সি ফান্ড’ও অফার করে থাকে।

আবার কখনো যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনে হয় যে ব্যাংকিং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওপেন মার্কেট অপারেশনস পরিচালনা করার মাধ্যমে সুদের হার ও মার্কেটের তারল্য নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কতো টাকা ঋণ দিতে পারবে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখে।

৪। ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর রেগুলেটরি রিফর্ম

২০০৭ - ২০০৮ সালের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর ব্যাংকিং সেক্টরকে আরো মজবুত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু রেগুলেটরি রিফর্ম আনা হয়।

আমেরিকায় Dodd-Frank Act - এর মাধ্যমে কনজ্যুমার ফাইন্যান্সিয়াল প্রোটেকশান ব্যুরো তৈরি করা হয় এবং বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়।

ব্যাসেল ৩ চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি শক্তিশালি করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বেটার লিক্যুইডিটি ম্যানেজমেন্ট, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও আরো বেশি স্বচ্ছতা অবলম্বন করা অন্তর্ভুক্ত।

৫। স্বচ্ছতা ও যোগাযোগ

জনগণের সাথে রেগুলেটরি অথোরিটিগুলোর ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন ব্যাংক ব্যবস্থায় জনগণের বিশ্বাস ধরে রাখার অন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বচ্ছতার সাথে রিপোর্টিং এবং জনগণকে তথ্য জানানোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো গুজব মোকাবিলা করতে পারছে এবং জনগণকে ভালো মানের সেবা প্রদান করতে পারছে।

পরিসংহার

এসব প্রিভেন্টিভ স্ট্র্যাটেজি ও রেগুলেটরি রিফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল অথোরিটিগুলো আরো রোবাস্ট এবং স্ট্যাবল ব্যাংক ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করছে। এতে করে অতীতের তুলনায় বর্তমানে ব্যাংক রানের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গিয়েছে। এই কারণে এখন ব্যাংক রান খুব সহজেই প্রেডিক্ট করা ও প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে, যা আগে এতো সহজ ছিল না। তথ্য-প্রযুক্তির আরো বিকাশের ফলে আগামীতে ব্যাংক রানের মতো পরিস্তিত আরো সহজে ট্যাকল করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

  • https://www.investopedia.com/terms/b/bankrun.asp#
  • https://www.bankrate.com/banking/what-is-a-bank-run/
  • https://www.nerdwallet.com/article/banking/what-is-a-bank-run
  • https://www.britannica.com/money/what-is-a-bank-run
  • https://www.wallstreetmojo.com/bank-run/
  • https://www.thestreet.com/dictionary/b/bank-run
  • https://corporatefinanceinstitute.com/resources/economics/bank-run/
  • https://www.studysmarter.co.uk/explanations/macroeconomics/financial-sector/bank-runs/
Next to read
Canvas & Methods
মিনিমাম ভায়েবল প্রোডাক্ট (Minimum Viable Product)
মিনিমাম ভায়েবল প্রোডাক্ট (Minimum Viable Product)

অধিক শ্রম ও অর্থ খরচের এই ঝুঁকি এড়াতে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন ধরনের বিজনেস স্ট্র‍্যাটেজি যেখানে পণ্য প্রয়োজনীয় কিছু ফিচার দিয়ে বাজারজাত করা হয়। পরবর্তীতে গ্রাহকদের চাহিদা পর্যালোচনা করে ধীরে ধীরে এই পণ্যের উন্নয়ন করা হয় এবং নতুন নতুন উপাদান/ফিচার যুক্ত করা হয়। ব্যবসায়িক জগতে একে বলা হয় মিনিমাম ভায়েবল প্রোডাক্ট।

অ্যাড অন মডেল (Add On Model)
Business Models
অ্যাড অন মডেল (Add On Model)
সারোগেট মার্কেটিং (SURROGATE MARKETING)
Marketing
সারোগেট মার্কেটিং (SURROGATE MARKETING)
মোট মুনাফা (Gross profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং উদাহরণ
Business
মোট মুনাফা (Gross profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং উদাহরণ
সেলস কি এবং কিভাবে তা কাজ করে?
Sales
সেলস কি এবং কিভাবে তা কাজ করে?
সেলস ফানেল বা বিক্রয় ফানেল কি?
Sales
সেলস ফানেল বা বিক্রয় ফানেল কি?
‘SWOT’ Analysis
Analysis
‘SWOT’ Analysis
সেলস এবং মার্কেটিং কিভাবে একসাথে কাজ করে
Sales
সেলস এবং মার্কেটিং কিভাবে একসাথে কাজ করে
MTNUT কাটিয়ে কিভাবে একটি সেলস ডিল ক্লোজ করবেন?
Sales
MTNUT কাটিয়ে কিভাবে একটি সেলস ডিল ক্লোজ করবেন?
General Agreement on Tariffs and Trade (GATT)
Agreement
General Agreement on Tariffs and Trade (GATT)