ব্যাংকিং কি এবং ব্যাংক কিভাবে কাজ করে?

ব্যাংক হচ্ছে এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যারা জনগণের সঞ্চিত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে এবং উক্ত আমানতের টাকা ঋণ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তিদের প্রদান করে। আর ব্যাংকের সাথে জড়িত যেকোনো ধরণের কার্যক্রমকে ব্যাংকিং বলা হয়। যেকোনো দেশের ব্যাংককে উক্ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।
Key Points
- সঞ্চয় গ্রহণ এবং ঋণ প্রদান, এই দুটোই হচ্ছে ব্যাংকের প্রধান কাজ।
- ব্যাংক বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের মাঝে অর্থ লেনদেনকারী হিসেবে কাজ করে।
- ব্যাংক অন্যদের ঋণ দিয়ে কিছু বেশি অর্থ সুদ হিসেবে আয় করে এবং পরে সেই সুদের একটি অংশ আমানতকারীদের দিয়ে দেয়।
- দেশের অন্য সকল ব্যাংক কিভাবে নিজেদের ব্যবসায় পরিচালনা করবে তা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকিং কি এবং ব্যাংক কিভাবে কাজ করে?
একটি ভালো এবং সুন্দর জীবনযাপনের জন্য নিজের ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট অতি জরুরি একটি বিষয়। আর ব্যাংক হচ্ছে এমনই প্রতিষ্ঠান যারা আপনার ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টের কাজ সহজ করে তোলে এবং আপনাকে একটি ভালো ও সুন্দর জীবন এনশিওর করার জন্য কাজ করে। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যাংক আরো অনেক আর্থিক সেবা প্রদান করে থাকে, যা ব্যবহার করে আমরা দৈনন্দিন জীবনকে আরো সুন্দর ও সহজ করে তুলতে পারি।
ব্যাংকের সেবা অনেকেই গ্রহণ করলেও, বেশিরভাগ মানুষই আসলে জানেন না বা বুঝেন না যে ব্যাংক কিভাবে কাজ করে। আজকের লেখায় আমরা সেটাই বোঝার চেষ্টা করবো।
ব্যাংক ও ব্যাংকিং কী?
ব্যাংক হচ্ছে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার কাছে জনগণের সঞ্চিত অর্থ সঞ্চয় হিসেবে জমা নেয়ার এবং সেই অর্থ থেকে জনগণকে আবার ঋণ প্রদান করার লাইসেন্স থাকে। আর একটি ব্যাংক যেসব কার্যক্রম পালন করে থাকেই তাকেই সহজ ভাষায় ব্যাংকিং বলা হয়। সঞ্চয় গ্রহণ এবং ঋণ প্রদান, এই দুটোই হচ্ছে ব্যাংকের প্রধান কাজ। তবে এই দুটোর পাশাপাশি ব্যাংক আরো বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে। যেমন -
- ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট।
- বন্ধকী ঋণ প্রদান।
- ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড।
- চেক ও বিল ভাঙালো।
- সম্পদ ব্যবস্থাপনা।
- লকার সার্ভিস ইত্যাদি।
ব্যাংক কীভাবে কাজ করে?
সহজ কথায়, ব্যাংক বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের মাঝে অর্থ লেনদেনকারী হিসেবে কাজ করে। ব্যাংক তার নিজস্ব ব্যাংকিং সার্ভিস হিসেবে সাধারণ মানুষকে অর্থ জমা রাখার একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে কাজ করে এবং পরবর্তীতে সেই সঞ্চিত অর্থ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ হিসেবে প্রদান করার মাধ্যমে ব্যাংক অর্থ উপার্জন করে।
ব্যাংক যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে, তাদের থেকে ঋণের মূল টাকার অতিরিক্ত অর্থ সুদ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এটিই হচ্ছে যেকোনো ব্যাংকের অর্থ উপার্জনের প্রধান মাধ্যম। ব্যাংকের মুনাফার সবচেয়ে বড় অংশ এখান থেকে আসে।
ঋণের অর্থ থেকে পাওয়া সুদের একটি অংশ আমানতকারীদের (যারা ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছিলেন) সুদ হিসেবে প্রদান করে। অর্থাৎ, ব্যাংক অন্যদের ঋণ দিয়ে কিছু বেশি অর্থ সুদ হিসেবে আয় করে এবং পরে সেই সুদের একটি অংশ আমানতকারীদের দিয়ে দেয়। এই দুইধরণের সুদের মাঝে যেই পার্থক্য, সেটিই হচ্ছে ব্যাংকের জন্য মুনাফা।
এছাড়াও, উপরে আমরা ব্যাংকের আরো যেসব সার্ভিসের কথা বলেছি, সেগুলো থেকেও ব্যাংকের কিছু টাকা আয় হয়। একটি মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এভাবেই ব্যাংক নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখে।
ব্যাংক যেহেতু অর্থনীতিতে টাকার লেনদেনের প্রধান ভূমিকা পালন করে, তাই এদের বেশ কঠোর নিয়মনীতি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। আর এইসব নিয়মনীতি তৈরি করে দেয় ঐ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক
“ব্যাংক” বলতে সকল ধরণের ব্যাংককে বোঝানো হলেও সকল ব্যাংকের কার্যক্রম কিন্তু এক নয়। বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের ব্যাংকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং সবার কার্যক্রম ভিন্ন। এই কারণেই ব্যাংকের প্রকারভেদ সম্পর্কে জানা জরুরি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলা ‘সকল ব্যাংকের ব্যাংকার’। অর্থাৎ, দেশের অন্য সকল ব্যাংক কিভাবে নিজেদের ব্যবসায় পরিচালনা করবে তা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি হয় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দ্বারা। যেমন - বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতি আদেশ নং ১২৭) দ্বারা গঠিত হয়েছিল।
অন্য সকল ব্যাংকের নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো কিছু দায়িত্ব পালন করে। যেমন -
১। মুদ্রানীতি তৈরি।
২। ব্যাংক নোট ছাপানো।
৩। ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল।
৪। সুদের হার নির্ধারণ।
৫। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক ব্যাংক
আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ব্যাংক দেখি, তার বেশিরভাগই আসলে বাণিজ্যিক ব্যাংক। এসব ব্যাংক গ্রাহকের থেকে অর্থ জমা রাখে এবং সেই অর্থের বড় একটি অংশ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা সাধারণ নাগরিকদের ঋণ হিসেবে প্রদান করে। তবে অর্থ লেনদের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অন্যান্য সুবিধা’ও প্রদান করে। যেমন - চেক ও বিল ভাঙানো, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, লকার সার্ভিস ইত্যাদি।
বিনিয়োগ ব্যাংক
বিনিয়োগ ব্যাংক মূলত বিভিন্ন বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে বিনিয়োগ ব্যাংকের মূল পার্থক্য হচ্ছে যে - বিনিয়োগ ব্যাংক গ্রাহকের থেকে অর্থ ডিপোজিট হিসেবে জমা নিতে পারে না।
কোনো বিনিয়োগকারী নিজের বিনিয়োগ ম্যানেজ করার কাজ যেকোনো বিনিয়োগ ব্যাংককে দিতে পারেন। তখন উক্ত ব্যাংক তার গ্রাহকের হয়ে বিনিয়োগ ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ ব্যাংক তার গ্রাহককে বিনিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন কনসাল্টেন্সি সার্ভিস’ও প্রদান করতে পারে।
ক্রেডিট ইউনিয়ন
বিনিয়োগ ব্যাংকের মতোই ক্রেডিট ইউনিয়ন সাধারণ মানুষের নিকট হতে অর্থ জমা হিসেবে গ্রহণ করে না। ক্রেডিট ইউনিয়ন মূলত কিছু সমমনা মানুষ মিলিত হয়ে এবং নিজেদের সঞ্চিত অর্থ জমা করে তৈরি করে থাকেন। এই সমমনা মানুষেরা হচ্ছেন ক্রেডিট ইউনিয়নের মেম্বার। নিজেদের টাকা একত্র করে তারা বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগ করে থাকেন অথবা মেম্বারদের ঋণ হিসেবে প্রদান করে থাকেন।
ডিজিটাল ব্যাংক
ডিজিটাল ব্যাংকের ধারণা বাংলাদেশে নতুন। ডিজিটাল ব্যাংক বলতে এমন সব প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয় যাদের কোনো ফিজিকাল শাখা নেই এবং সকল কার্যক্রম অনলাইনেই পরিচালনা করা হয়। এদের কার্যক্রম বিভিন্ন নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিকাশ/নগদের মতো হলেও, বিকাশ/নগদ জনগণের নিকট হতে আমানত হিসেবে অর্থ গ্রহণ করতে পারে না। অন্যদিকে ডিজিটাল ব্যাংক জনগণের নিকট হতে আমানত হিসেবে অর্থ গ্রহণ করতে পারে।
বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
বর্তমানে ব্যাংকে গেলে অনেক ধরণের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেখা যায়। একেক ব্যাংক নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী সেসব অ্যাকাউন্টের নামকরণ করে থাকে। তবে মোটাদাগে ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
১। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাব
এই ধরণের হিসাব মূলত ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকেন। চলতি হিসাবের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এই অ্যাকাউন্টে দিনে যতোবার ইচ্ছা টাকা জমা দেয়া যায় এবং যতোবার ইচ্ছা অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যায়। অর্থাৎ, এই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারেন।
এই অ্যাকাউন্টে জমাকৃত টাকার বিনিময়ে বেশ সামান্য পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, আবার কোনো কোনো ব্যাংক একেবারেই কোনো সুদ প্রদান করে না। এই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ব্যাংক ডেবিট কার্ডের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড’ও অফার করে থাকে। অর্থাৎ, প্রয়োজনে ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের কিছু অতিরিক্ত অর্থ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে জমাতিরিক্ত ঋণ হিসেবে নেয়া যায়।
এই অ্যাকাউন্টে সুদের পরিমাণ বেশ কম হলেও, চার্জের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
২। সেভিংস অ্যাকাউন্ট বা সঞ্চয়ী হিসাব
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই অ্যাকাউন্ট সাধারণ জনগণ টাকা জমানোর জন্য ব্যবহার করে থাকেন। দিনে যতোবার ইচ্ছা টাকা জমা দেয়া গেলেও দিনে বা মাসে একটি নির্দিষ্ট বারের বেশি টাকা তোলা যায় না, অর্থাৎ এখানে কিছু নিয়মনীতি রয়েছে।
এই অ্যাকাউন্ট থেকে সাধারণত কারেন্ট অ্যাকাউন্টের তুলনায় কিছুটা বেশ সুদ পাওয়া যায়, তবে এই অ্যাকাউন্টের বিপরীত ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড অফার করে না।
ক্রেডিট পাওয়া না গেলেও ডেবিট কার্ড পাওয়া যায় এবং এই অ্যাকাউন্টের চার্জের পরিমাণ সাধারণত কারেন্ট অ্যাকাউন্টের তুলনায় কম হয়ে থাকে।
৩। ফিক্সড ডিপোজিট অথবা স্থায়ী হিসাব
এই অ্যাকাউন্ট সাধারণত ১ বছরের অধিক সময়ের জন্য খোলা হয় এবং প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ডিপোজিট হিসেবে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। অ্যাকাউন্টের মেয়াদ শেষে ব্যাংক সুদাসল একসাথে ফেরত প্রদান করে। অর্থাৎ, এই অ্যাকাউন্ট থেকে যখন ইচ্ছা টাকা তোলা যায় না। মেয়াদপূর্তির আগেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিলে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর বিপরীতে কোনো সুদ পাওয়া যায় না।
এই ধরণের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ব্যাংক কোনো ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড অফার করে না এবং এই অ্যাকাউন্টের চার্জের পরিমাণ অন্য অ্যাকাউন্টগুলোর তুলনায় অনেক কম হয়ে থাকে।
পরিসংহার
একটি দেশের অর্থব্যবস্থার একদম কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থান করে বিভিন্ন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। শুধু টাকা গ্রহণ এবং ঋণ প্রদান নয়, বরং সমস্ত অর্থনীতিতে টাকার সুষ্ঠু প্রবাহ বজায় রাখার জন্য ব্যাংকগুলোর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকার মাধ্যমে ফিজিকাল নোটের বিভিন্ন ধরণের অনিশ্চয়তা যেমন - হারিয়ে যাওয়া বা ছিনতাই হওয়া ইত্যাদি সমস্যা এড়িয়ে চলা যায়। তাই ব্যক্তিজীবন এবং দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থায় ব্যাংক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
- https://www.dbs.com/digibank/in/articles/save/what-is-banking
- https://www.forbes.com/advisor/banking/how-do-banks-work/
- https://www.investopedia.com/terms/b/bank.asp
- https://www.imf.org/external/pubs/ft/fandd/2012/03/basics.htm
- https://corporatefinanceinstitute.com/resources/wealth-management/banking-fundamentals/
Next to read
লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)


লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)

ব্রান্ডিং (Branding)

ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা Micro Economics কী?

বিনিয়োগ কি? বিনিয়োগের ধরণ এবং উদাহরণ

এঞ্জেল বিনিয়োগ কি? এবং কিভাবে কাজ করে (What is angel investing & how does it work?)

ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন

হিসাববিজ্ঞান পরিচিতি (What is Accounting)

ব্রেটন উডস এগ্রিমেন্ট
