CSR বা Corporate Social Responsibility কী?

ব্যবসায় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সমাজকে কেন্দ্র করেই তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে, এর ফলে সমাজের মানুষজন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ের কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। তাছাড়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সমাজের বা দেশের মানুষের কাছে তার পণ্য, সেবা বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে থাকে। তাই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গুলোর সমাজ এবং দেশের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, এই দায়িত্ববোধ থেকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সমাজ, দেশ এবং বিভিন্ন পক্ষের প্রতি যে জনকল্যাণমূলক বা জনহিতকর কাজ করে থাকে তাকেই CSR/Corporate Social Responsibility বা ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে।
Key Points
- কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজগুলো করা কোম্পানির কর্তব্য
- ব্যবসায় নিজেই সামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাই সেই সমাজের প্রতি ভালো কিছু করা তার জন্যই মঙ্গলজনক
- কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজগুলো সমাজ,দেশ,জাতিকে উন্নত করে
- ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোম্পানির কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা মেনেচলা গুরুত্বপূর্ণ
- কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে কোম্পানির যে খরচ হয় তার বিনিময়ে কোম্পানি কয়েকগুণ বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে।
মূলত ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা হলো সমাজ এবং সমাজ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের প্রতি ব্যবসায়ের কর্তব্য পালনের দায় যা সমাজ থেকে প্রাপ্ত নানান সুবিধা ও সহযোগিতার বিপক্ষে তার করা উচিত।
১৯৭০ এর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী কোম্পানি এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো CSR বা ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ শুরু করে।
আইএসও বা আন্তর্জাতিক স্ট্যার্ন্ডাড অর্গানাইজেশনের মান-২৬০০০ ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।
ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা শুধু দেশ বা জাতির জন্য কিছু সেবামূলক কাজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পক্ষের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
বিভিন্ন পক্ষের প্রতি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের যে সকল সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে হয়।
১| ক্রেতা ও ভোক্তার প্রতি দায়বদ্ধতা:- পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ করা। চাহিদা মত পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করা এবং সহজ শর্তে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। নতুন পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহ করে ক্রেতাদের সর্বোচ্চ তৃপ্তি দানের ব্যবস্থা করা। ভেজাল এবং মেয়াদউত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি না করা।
২| শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি দায়বদ্ধতা:- উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও আর্থিক সুবিধা প্রদান। চাকরির নিরাপত্তা বিধান ও ভবিষ্যৎ আর্থিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা। শ্রমিকদের সাথে ভালো আচরণ করা। বেতন বহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
৩| বিনিয়োগকারী ও সরবরাহকারীদের প্রতি দায়বদ্ধতা:- পাওনাদারদের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করা। শেয়ারহোল্ডারদের ন্যায্য ও উৎসাহব্যঞ্জক লভ্যাংশ প্রদান করা। কোম্পানি পরিচালনার সকল তথ্য অংশীদার এবং শেয়ারহোল্ডারদের জানানো।
৪| সরকারের প্রতি দায়বদ্ধতা:- সরকারকে যথারীতি কর ও রাজস্ব প্রদান করা। সরকারি নিয়ম-নীতির যথাযথ অনুসরণ করা। সরকারকে বিভিন্ন খারাপ পরিস্থিতিতে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা।
৫| প্রতিযোগী ব্যবসায়ীর প্রতি দায়বদ্ধতা:- অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অস্বাস্থ্যকর কোন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া। প্রতিযোগী কোম্পানির কোন পণ্য বা কর্মকাণ্ড হুবহু নকল না করা। সর্বোপরি প্রতিযোগীকে শত্রু মনে না করে প্রতিযোগী হিসেবে গণ্য করা।
৬| সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা:- পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এরকম কাজ থেকে বিরত থাকা। যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য করা। দুঃস্থ মানুষদের সহযোগিতা করা, মেধাবী এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা করা। বেকার সমস্যা দূরীকরণে বেশি বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
CSR বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রকারভেদ:-
১| অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা:- কোম্পানির বা ব্যবসায়ের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজ, দেশ এবং জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করা। সমাজের মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা ইত্যাদিকে অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা বলে।
২| নৈতিক দায়বদ্ধতা:- ন্যায়, নৈতিকতা এবং নিয়মকানুন মেনে ব্যবসায় পরিচালনা করাকেই নৈতিক দায়বদ্ধতা বলে। এই প্রক্রিয়ায় কোম্পানি সকল ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে।
৩| পরিবেশগত দায়বদ্ধতা:- কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নদী, বাতাস, মাটি, পানি ও শব্দ দূষণ করে থাকে, এই সব দূষণ না করে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করাকেই পরিবেশগত দায়বদ্ধতা বলে। এই দায়বদ্ধতা পালনের মাধ্যমে কোম্পানিরা পরিবেশের প্রতি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে, পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করতে পারে, গাছ লাগানোর মত পরিবেশ রক্ষক কাজ গুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৪| জনকল্যাণ বা জনহিতকর দায়বদ্ধতা:- দেশের জনগণের বিপদে সহযোগিতা করাকেই জনকল্যাণ বা জনহিতকর দায়বদ্ধতা বলে। বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতা করা এই দায়বদ্ধতার ভিতরে অন্তর্ভুক্ত।
CSR বা ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে কোম্পানিকে ভালোই খরচ করতে হয়। আসলে এই খরচ কোম্পানিকে কয়েকগুণ বেশি বেনিফিটেড করে থাকে, তাই ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করা কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
CSR বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ;
১| কোম্পানি সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে বিভিন্ন জনহিতকর কাজে অংশগ্রহণ করে যার ফলে কোম্পানির সুনাম বৃদ্ধি পায়।
২| এর মাধ্যমে ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্নেস বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর মানুষ কোম্পানি সম্পর্ক অবগত হয়।
৩| প্রতিযোগী কোম্পানি থেকে মার্কেটে অনেকটা এগিয়ে থাকা যায়।
৪| বেতন বহির্ভূত বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদানের কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে আগ্রহ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া নতুন নতুন দক্ষ শিক্ষিত তরুণরা এই কোম্পানিতে কাজ করতে মুখিয়ে থাকে।
৫| কোম্পানির প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায় তাই নতুন ভোক্তা আসে এবং বিক্রয় বাড়তে শুরু করে।
৬| কোম্পানি সরকারের সু-দৃষ্টিতে থাকে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়।
৭| এই সব সুবিধা গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানির ওভারঅল রেভিনিউ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের যে সকল কোম্পানিগুলো CSR বা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে, তাদের কিছু কার্যক্রম দেখে আসি চলুন।
১| ডাচ বাংলা ব্যাংক:- বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহের মধ্যে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে ডাচ বাংলা ব্যাংক সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। প্রতিবছর ব্যাংকটি সারাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে থাকে যার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকার মত। ২০০৩ সালে তারা ৩০০০ এর বেশি ঠোঁট কাটা রোগীর প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা করেছে। ২০০৭ সালে সিডর দুর্গত মানুষের জন্য ব্যাংকটি প্রায় ৪.৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া পরিবেশ সুরক্ষা এবং ভোটার আইডি কার্ড তৈরি সহ বিভিন্ন খাতে তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
২| আকিজ গ্রুপ:- তারা চিকিৎসা খাতে অনেক অবদান রেখে চলেছে। তাদের আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের অধীনে ঢাকা সহ সারাদেশের বিভিন্ন বিভাগে প্রায় ১০ টি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে যেখানে নাম মাত্র মূল্যে দুঃস্থ মানুষেরা চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকে। তাদের অঙ্গ সংগঠন আকিজ ফুটওয়্যার লি. ঢাকায় টেলিফোন কলের মাধ্যমে খুবই কম খরচে এ্যাম্বুলেন্সের সার্ভিস পরিচালনা করছে।
৩| গ্রামীণফোন:- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন CSR এর আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে সমাজের মানুষদের জন্য কাজ করে চলেছে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিলে শিশুদের পোলিও খাওয়ানো ও টীকাদান কর্মসূচিতে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ২০২২ সালে সিলেটের বন্যা চলাকালীন সময়ে গ্রামীণফোন ইউজারদের ফ্রি টকটাইম দিচ্ছে যা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতারই অংশ।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার খরচ করে থাকে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায়। জলবায়ু ঠিক রাখতে মাইক্রোসফট,অ্যাপেল,টাটা সহ বিশ্বের অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে যা ক্রেতাদের মাঝে তাদের ব্র্যান্ড লয়েলিটি বাড়াচ্ছে।
- ফান্ডামেন্টাল অব বিজনেস অর্গানাইজন, বাংলাদেশ ব্যাংক বার্ষিক রিপোর্ট
Next to read
সোশ্যাল বিজনেস মডেল ক্যানভাস (Social Business Model Canvas)


বিজনেস মডেল ক্যানভাস ( Business Model Canvas)

শেয়ারিং ইকোনমি মডেল (Sharing Economy Model)

Needs, Wants, Demands (প্রয়োজন, চাওয়া এবং চাহিদা)

লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)

ব্রান্ডিং (Branding)

PESTLE বিশ্লেষণ

ই-কমার্স: অনলাইন ব্যবসা

সেলস এবং মার্কেটিং কিভাবে একসাথে কাজ করে
