মোট মুনাফার হার: সংজ্ঞা সূত্র এবং ক্যালকুলেশন

কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক লাভজনকতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত মোট মুনাফার হার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পণ্য বা সেবার নিট বিক্রয়মূল্য থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বিয়োগ দিয়ে মোট মুনাফা নির্ণয় করা হয়। মোট মুনাফার হার’কে নিট বিক্রয় দিয়ে ভাগ করলে আমরা মোট মুনাফার হার পেয়ে যাই। সাধারণত, বিক্রয়কৃত অর্থের মোট কতো শতাংশ মুনাফা হচ্ছে তার প্রকাশ করা হয় মোট মুনাফার হার দিয়ে।
Key Points
- মোট মুনাফা’কে নিট বিক্রয় দিয়ে ভাগ করলেই আমরা পেয়ে যাই মোট মুনাফার হার।
- মোট মুনাফার হার = ( নিট বিক্রয় - বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ) / নিট বিক্রয়
- সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফার হার অনেক বেশি হয়ে থাকে, কারণ এই শিল্পে ‘বিক্রীত পণ্যের ব্যয়’ খুবই কম হয়। অন্যদিকে, পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফার হার কম হয়ে থাকে, কারণ এই শিল্পে ‘বিক্রীত পণ্যের ব্যয়’ অনেক বেশি।
- একটি প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতা যাচাইয়ের তিনটি সূচকের মধ্যে মোট মুনাফার হার প্রথম সূচক।
কথামুখ
বিজনেস স্টাডিজ ব্যাকগ্রাউন্ড নয় এমন উদ্দ্যেক্তাদের হরহামেশাই একটি কমন সমস্যা ফেস করতে হয়, সেটি হচ্ছে ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন টার্ম তাদের জানা থাকে না। নিট বিক্রয়, বিক্রীত পণ্যের ব্যয়, মোট মুনাফার হার, নিট মুনাফার হার ইত্যাদি শব্দ তাদের কাছে ধাধার মতো শোনায়। বিজনেস স্টাডিজের স্টুডেন্ট হোন বা না হোন, আপনিও কি একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন? উত্তরটি যদি ‘হ্যা’ হয়ে থাকে তবে আর চিন্তা করতে হবে না। আশা করি, এই সমস্যার অনেকটাই আজ আমরা সমাধান করে দিতে পারবো।
সাবলীলভাবে ব্যবসা পরিচালনা এবং আর্থিক প্রতিবেদনগুলোর তথ্যের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য উপরে উল্লিখিত সবগুলো টার্ম’ই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে, যদি বলেন একটি সিঙ্গেল টার্ম, যার মাধ্যমে আপনার ব্যবসার সার্বিক অবস্থা অনেকটাই আচ করে ফেলা যায়, সেটি হচ্ছে ‘মোট মুনাফার হার’। আজ আমরা মোট মুনাফার হারের আদ্যোপান্ত জানব এবং কিভাবে ক্যালকুলেট করতে হবে সেটিও দেখবো।
মোট মুনাফার হার কি?
যদি সংক্ষেপে বলি, নিট বিক্রয় থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বাদ দেয়ার পর মোট মুনাফার পরিমাণ পাওয়া যায়। মোট মুনাফা’কে নিট বিক্রয় দিয়ে ভাগ করলেই আমরা পেয়ে যাই মোট মুনাফার হার।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাক। আপনি ৩০ টাকা দিয়ে একটি পণ্য ক্রয় করে সেটিকে ৫০ টাকায় বিক্রয় করলেন। তাহলে এখানে আপনার মুনাফা হলো (৫০ - ৩০) = ২০ টাকা এবং আপনার মোট মুনাফার হার হলো (২০ / ৫০) = ০.৪ অথবা ৪০%।
অর্থাৎ, কোম্পানীর বিক্রিত পণ্য বা সেবার সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় খরচ মেটানোর পর বিক্রয়কৃত অর্থের যে অংশ অবশিষ্ট থাকে, নিট বিক্রয়ের সাথে সেই অংশের অনুপাতই হচ্ছে মোট মুনাফার হার। একটি কোম্পানীর মোট মুনাফার হার যতো বেশি হয়, তাদের মুনাফার পরিমানও ততো বেশি হয়ে থাকে।
মোট মুনাফার হার কিভাবে ক্যালকুলেট করবেন?
মোট মুনাফার হার = ( নিট বিক্রয় - বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ) / নিট বিক্রয়
এবার আসুন, মোট মুনাফার হার ক্যালকুলেশনের সুবিধার্থে এর সাথে সম্পর্কিত কিছু টার্মের বিস্তারিত জেনে নেই -
নিট বিক্রয় - পণ্য বা সেবা বিক্রয় করে যে এমাউন্ট পাওয়া যায় তার থেকে বিক্রয় ফেরত এবং ডিস্কাউন্ট দেয়া অর্থ বাদ দিলেই নিট বিক্রয় পাওয়া যাবে। বিক্রয় ফেরত এবং ডিস্কাউন্টের পরিমাণ বিক্রয় থেকে বাদ দেয়া হয় কারণ, এগুলো প্রকৃত বিক্রয়ের পরিমাণকে কমিয়ে ফেলে। এই কারণে মোট বিক্রয় এবং প্রকৃত বিক্রয়ের মাঝে ব্যবধান তৈরি হয়।
বিক্রীত পণ্যের ব্যয় - আপনি যে পণ্য বা সেবাটি বিক্রয় করছেন তার ক্রয় এবং পরিবহন সম্পর্কিত যাবতীয় খরচকে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বলা হয়।
অর্থাৎ,
বিক্রীত পণ্যের ব্যয় = {( ক্রয় - ফেরত - ডিস্কাউন্ট ) + পরিবহন খরচ + মজুরি ব্যয় + আমদানি শুল্ক } - সমাপণী মজুদ পণ্য
একটি উদারণের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়া যাক -
উদাহরণ - এপ্রিল মাসে আপনার মোট বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৫,০০,০০০ টাকা। বিক্রয় ফেরত এবং সেলস ডিস্কাউন্ড ছিল যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ৫,০০০ টাকা। বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ছিল ৩,৮৮,০০০ টাকা। তাহলে আপনার মোট মুনফার পরিমাণ এবং মোট মুনাফার হার কতো?
সমাধান - মোট মুনাফার পরিমাণ:
বিবরণ | টাকা |
মোট বিক্রয় | ৫,০০,০০০ |
বিয়োগঃ বিক্রয় ফেরত | ১০,০০০ |
বিয়োগঃ সেলস ডিস্কাউন্ট | ৫,০০০ |
নিট বিক্রয় | ৪,৮৫,০০০ |
বিয়োগঃ বিক্রীত পণ্যের ব্যয় | ৩,৮৮,০০০ |
মোট মুনাফা | ৯৭০০০ |
মোট মুনাফার হার = ৯৭,০০০ / ৪,৮৫,০০০ = ০.২ অথবা ২০%
এখানে, আপনার মোট বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৫,০০,০০০ টাকা। বিক্রয়ের আনুষাঙ্গিক খরচ ১৫০০০ টাকা বাদ দিয়ে নিট বিক্রয় পাওয়া গেল ৪,৮৫,০০০ টাকা। নিট বিক্রয় থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বাবদ ৩,৮৮,০০০ টাকা বাদ দিয়ে আমরা মোট মুনাফা পেলাম ৯৭,০০০ টাকা। এবার মোট মুনাফার ৯৭,০০০ টাকা’কে আমরা নিট বিক্রয়ের ৪,৮৫,০০০ টাকা দিয়ে ভাগ করে মোট মুনাফার হার পেলাম ২০%।
মোট মুনাফা এবং মোট মুনাফার হারের মাঝে পার্থক্য কী?
নিট বিক্রয় থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বিয়োগ করলে যে এমাউন্ট পাওয়া যায়, তাকেই মোট মুনাফা বলা হয়। অপরদিকে, মোট মুনাফাকে নিট বিক্রয় দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই মোট মুনাফার হার। অর্থাৎ, মোট মুনাফা ব্যবসা পরিচালনা থেকে প্রাথমিক লাভের অংককে প্রকাশ করে এবং মোট মুনাফার হার আমাদের জানায় বিক্রয় থেকে পাওয়া অর্থের কতো শতাংশ আমাদের মুনাফা হয়েছে।
আদর্শ মোট মুনাফার হার কতো?
মোট মুনাফার আদর্শ মান প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফার হার অনেক বেশি হয়ে থাকে, কারণ এই শিল্পে ‘বিক্রীত পণ্যের ব্যয়’ খুবই কম হয়। অন্যদিকে, পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফার হার কম হয়ে থাকে, কারণ এই শিল্পে ‘বিক্রীত পণ্যের ব্যয়’ অনেক বেশি।
McDonalds কোম্পানীর সাথে মোটামুটি আমরা সকলেই পরিচিত। “করপোরেট ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউট’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে এই কোম্পানীর মোট মুনাফার হার ছিল ৪১.৪%। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ব্যাংক অব আমেরিকার মোট মুনাফার হার ছিল ৯৭.৮%!’’।
এই দুটি কোম্পানীর মোট মুনাফার হারের পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন? অথচ, একটু চিন্তা করলেই কিন্তু এতো বেশি পার্থক্যের কারণ পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্যাংল অব আমেরিকা একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, তাই তাদের বিক্রীত পণ্যের ব্যয় নেই বললেই চলে। ফলস্বরুপ, তাদের মোট মুনাফার হার এতো বেশি। অন্যদিকে ম্যাকডোনাল্ডস একটি পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, তাদের বিক্রীত পণ্যের ব্যয়ের পরিমানও বেশি। তাই তো তাদের মোট মুনাফার হার ৫০ শতাংশেরও কম।
মোট মুনাফার হার বৃদ্ধি করবেন কিভাবে?
মোট মুনাফার হার যতো বেশি হয়ে থাকে, প্রতিষ্ঠানটিকে ততো বেশি লাভজনক ধরা হয়। কিছু সাধারণ স্টেপ ফলো করার মাধ্যমেই আপনিও আপনার প্রতিষ্ঠানের মোট মুনাফার হার বৃদ্ধি করতে পারবেন।
১। কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করার চেষ্টা করুন।
পণ্য বা কাঁচামাল যতো কম মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন আপনার প্রতিষ্ঠানের মোট মুনাফার হার ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে। কারণ, বিক্রীত পণ্যের ব্যয়ের সাথে মোট মুনাফার হার’র বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই, বিক্রীত পণ্যের ব্যয় কমানো সম্ভব হলে মোট মুনাফার হার’ও বৃদ্ধি পাবে।
২। পণ্যের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধি
যদি পণ্যের ক্রয়মূল্য কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে পণ্যের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন যাতে বিক্রয়মূল্য অনেক বেশি না হয়ে যায়, নইলে বিক্রয়ের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
মোট মুনাফার হার’র গুরুত্ব
একটি প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতা যাচাইয়ের তিনটি সূচকের মধ্যে মোট মুনাফার হার প্রথম সূচক। অন্য দুইটি হচ্ছে, পরিচালন মুনাফার হার এবং নিট মুনাফার হার। প্রতিষ্ঠানের ক্রয় ও বিক্রয় কার্যাবলি যথাযথ ভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না সেই সম্পর্কে জানতে মোট মুনাফার আমাদের সাহায্য করে। আরো যেসব কারণে মোট মুনাফার হার গুরুত্বপূর্ণ -
- ব্যবসায়ে বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার সম্পর্কে জানায় মোট মুনাফার হার।
- সঠিক বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে সাহায্য করে।
- বিজনেস মডেলের কার্যকারিতা নির্ধারণে মোট মুনাফার হার সাহায্য করে।
- মোট মুনাফার হার ব্যবসায়ের গ্রোথ পটেনশিয়ালিটি প্রকাশ করে।
পরিসংহার
পরিশেষে বলা যায়, দীর্ঘসময় মোট মুনাফার হারের প্রতি অবহেলা যেকোনো ব্যবসায়ের টিকে থাকার প্রতি হুমকিস্বরুপ হতে পারে। তাই সঠিক উপায়ে মোট মুনাফার হার নির্ধারণ করে তা বিশ্লেষনের মাধ্যমে ব্যবসায়ের গ্রোথ পটেনশিয়ালিটি ধরে রাখতে হবে।
- তথ্যসূত্র
- https://www.fool.com/investing/how-to-invest/stocks/gross-margin/
- https://www.investopedia.com/terms/g/grossmargin.asp
- https://www.profitwell.com/recur/all/blog/gross-margin/
- Accounting Principles (12th Edition) - Weygandt, Kimmel, Kieso
- Fact and Figure
- Corporate Finance link :
- https://corporatefinanceinstitute.com/resources/knowledge/finance/gross-margin-ratio/
Next to read
সোশ্যাল বিজনেস মডেল ক্যানভাস (Social Business Model Canvas)


বেইট এন্ড হুক মডেল (Bait & Hook Model)

সাবস্ক্রিপশন মডেল (Subscription Model)

Needs, Wants, Demands (প্রয়োজন, চাওয়া এবং চাহিদা)

রেড ওশান এবং ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি (Red Ocean & Blue Ocean Strategy with Example

নিট মুনাফা (net profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং কিভাবে হিসাব করবেন

হোরেকা (HORECA)

এঞ্জেল বিনিয়োগ কি? এবং কিভাবে কাজ করে (What is angel investing & how does it work?)

PESTLE বিশ্লেষণ
