মোট মুনাফা এবং নিট মুনাফার মাঝে পার্থক্য

ব্যবসায়ের ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা জানতে মোট মুনাফা সাহয্য করে। অপরদিকে, মোট মুনাফার ঠিক কতোটা অংশ দিয়ে পরিচালন ব্যয় মেটাতে হচ্ছে তা জানায় নিট মুনাফা। মোট মুনাফার ওপর নিট মুনাফার পরিমাণ নির্ভর করে। মোট মুনাফার পরিমাণ ভালো হলে, নিট মুনাফা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মোট মুনাফা কমে গেলে, নিট মুনাফা’ও কমে যায়।
Key Points
- পণ্যের বিক্রয়মূল্য থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বিয়োগ করলে যে এমাউন্ট পাওয়া যায়, তাকে মোট মুনাফা বলে।
- নিট মুনাফা জানতে হলে আগেই মোট মুনাফা বের করে নিতে হয়। এরপর মোট মুনাফা থেকে পরিচালনা ব্যয়, ঋণের সুদ, করপোরেট ট্যাক্স বিয়োগ করে নিলেই নিট মুনাফা বের হয়ে আসে।
- ব্যবসায়ের মুনাফালভ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নিট মুনাফা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
- মোট মুনাফা = বিক্রয় - বিক্রীত পণ্যের ব্যয়
- নিট মুনাফা = মোট মুনাফা - পরিচালন ব্যয় - ঋণের সুদ - ট্যাক্স
- সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা = মোট আয়সমূহ - মোট ব্যয়সমূহ
কথামুখ
ব্যবসায়ের সফলতা ও ব্যর্থতা যাচাইয়ের একক হচ্ছে মুনাফা। যে প্রতিষ্ঠান বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন করতে পারে তাকেই সাধারণত আমরা সফল প্রতিষ্ঠান বলে থাকি। তবে মুনাফা যাচাইয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক উপায়ে মুনাফা ক্যালকুলেট করা। সঠিক উপায়ে মুনাফা ক্যালকুলেট করতে না পারলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
বিক্রয় থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বিয়োগ করে দিলেই আমরা মোট মুনাফা পেয়ে যাই এবং মোট মুনাফা থেকে ব্যবসায়ের অন্যান্য যাবতীয় খরচ বিয়োগ করলেই পেয়ে যাই নিট মুনাফা। নিট মুনাফাকেই ব্যবসায়ের আল্টিমেট প্রফিট হিসেবে ধরা হয় এবং এর উপর ভিত্তি করেই মালিক ও শেয়ারহোল্ডারগণ পরবর্তী সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করে থাকেন। তাই প্রথমেই মোট মুনাফা ও নিট মুনাফার পার্থক্য এবং ক্যালকুলেট করার সঠিক নিয়ম জানা প্রয়োজন।
মোট মুনাফা কী?
পণ্যের বিক্রয়মূল্য থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বিয়োগ করলে যে এমাউন্ট পাওয়া যায়, তাকে মোট মুনাফা বলে। অর্থাৎ, বিক্রীত পণ্যের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যয়সমূহ (যেমন - পণ্য ক্রয়, পরিবহন খরচ, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি) মেটানোর পর অবশিষ্ট অর্থ’কে আমরা মোট মুনাফা হিসেবে জানি।
একটি প্রতিষ্ঠান ঠিক কতোটা দক্ষতার সাথে তাদের ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটি জানতে মোট মুনাফা সাহায্য করে। যেহেতু যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কার্যক্রম হচ্ছে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়, তাই এটি সাবলীলভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা জানা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
নিট মুনাফা কী?
একটি প্রতিষ্ঠানের সকল ধরণের ব্যয় (যেমন - বিক্রীত পণ্যের ব্যয়, পরিচালনা ব্যয়, ঋণের সুদ, ট্যাক্স ইত্যাদি) মেটানোর পর মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাকেই নিট মুনাফা বলা হয়। নিট মুনাফা জানতে হলে আগেই মোট মুনাফা বের করে নিতে হয়। এরপর মোট মুনাফা থেকে পরিচালনা ব্যয়, ঋণের সুদ, করপোরেট ট্যাক্স বিয়োগ করে নিলেই নিট মুনাফা বের হয়ে আসে। মোট আয়ের থেকে মোট ব্যয়ের পরিমাণ যদি বেশি হয়ে থাকে তবে তাকে আমরা নিট ক্ষতি বলি।
ব্যবসায়ের মুনাফালভ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নিট মুনাফা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। একটি প্রতিষ্ঠানের মোট মুনাফা অনেক বেশি হতে পারে, তবে পরিচালনা খরচ, সুদ, ট্যাক্স ইত্যাদির পরিমাণ যদি অতিরিক্ত হয়ে থাকে তবে মোট মুনাফার তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। যার ফলে মালিক বা শেয়ারহোল্ডার পক্ষকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না।
মোট মুনাফা ও নিট মুনাফা ক্যালকুলেট করবেন কীভাবে
মোট মুনাফা = বিক্রয় - বিক্রীত পণ্যের ব্যয়
অর্থাৎ, মোট মুনাফার পরিমাণ জানতে চাইলে আপনার অবশ্যই বিক্রয় এবং বিক্রীত পণ্যের ব্যয়ের পরিমাণ জানা থাকতে হবে। অপরদিকে,
নিট মুনাফা = মোট মুনাফা - পরিচালন ব্যয় - ঋণের সুদ - ট্যাক্স
অর্থাৎ, নিট মুনাফার পরিমাণ জানতে চাইলে আপনাকে আগেই মোট মুনাফা বের করে নিতে হবে এবং তারপর অন্যান্য যাবতীয় খরচ বিয়োগ করে দিলেই নিট মুনাফা বের হয়ে আসবে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট ধারণা নেয়া যাক -
মনে করুন, ফেব্রুয়ারি মাসে আপনার মোট বিক্রয়ের পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা। এই পরিমাণ পণ্য বিক্রয় করতে আপনার বিক্রীত পণ্যের ব্যয় হয়েছে ২৮,০০০ টাকা। ব্যবসায় পরিচালনা বাবদ খরচ হয়েছে ১০,০০০ টাকা। আপনি সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ব্যবসায়টি শুরু করেছেন, তাই আপনার কোনো সুদ খরচ নেই। তবে ৩৫% ট্যাক্স দিতে হয় সরকারকে। এবার চলুন জেনে আসা যাক ফেব্রুয়ারি মাসে আপনার মোট ও নিট মুনাফা কতো হলো।
বিবরণ | টাকা |
বিক্রয় | ৫০,০০০ |
বিয়োগ, বিক্রীত পণ্যের ব্যয় | ২৮,০০০ |
মোট মুনাফা | ২২,০০০ |
বিয়োগ, পরিচালনা খরচ | ১০,০০০ |
পরিচালন মুনাফা | ১২,০০০ |
বিয়োগ, করপোরেট ট্যাক্স (৩৫%) | ৪২০০ |
নিট মুনাফা | ৭৮০০ |
অর্থাৎ, আপনার পণ্য বিক্রয় হয়েছিল ৫০,০০০ টাকা। সেখান থেকে আপনি মোট মুনাফা অর্জন করতে পেরেছেন ২২,০০০ টাকা এবং নিট মুনাফা অর্জন করতে পেরেছেন ৭৮০০ টাকা।
সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফা ও নিট মুনাফা
যেসকল প্রতিষ্ঠান কোনো ধরণের ফিজিকাল প্রোডাক্ট বিক্রয় না করে বিভিন্ন সেবা বিক্রয় করে থাকে তাদের সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান বলা হয় (যেমন - সেলুন, মোবাইল সার্ভিসিং, ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিস ইত্যাদি)। এসব প্রতিষ্ঠান যেহেতু কোনো পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় করে না, তাই এদের কোনো বিক্রীত পণ্যের ব্যয় নেই। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট মুনাফা বের না করেই ডিরেক্টলি নিট মুনাফা ক্যালকুলেট করা যায়।
সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা = মোট আয়সমূহ - মোট ব্যয়সমূহ
অর্থাৎ, মোট আয় থেকে সরাসরি মোট ব্যয়ের পরিমাণ বিয়োগ করে দিলেই নিট মুনাফার পরিমাণ বের হয়ে আসবে। এখানে ব্যয়গুলোকে “বিক্রীত পণ্যের ব্যয়”, “পরিচালন ব্যয়” ইত্যাদি সেগমেন্টে ভাগ করার প্রয়োজন নেই।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়া যাক -
মনে করুন, আপনি একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি পরিচালনা করছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ক্লায়েন্টদের সেবা প্রদান করে আপনি মোট ১,৫০,০০০ টাকা আয় করেছেন। অপরদিকে আপনার কর্মীদের বেতন, অফিস ভাড়া ও ইন্টারনেট বিলসহ মোট ব্যয় হয়েছে ৫০,০০০ টাকা। তাহলে আপনার নিট মুনাফার পরিমাণ হবে -
নিট মুনাফা = ১,৫০,০০০ - ৫০,০০০ = ১,০০,০০০ টাকা
এইক্ষেত্রে মোট মুনাফার পরিমাণ না জেনেই আমরা নিট মুনাফার পরিমাণ বের করে ফেলতে পেরেছি।
মোট মুনাফা এবং নিট মুনাফার মাঝে পার্থক্য জানার গুরুত্ব
উপরের উদাহরণটি যদি ভালো করে লক্ষ্য করেন তবে একটি বিষয় আশা করি ধরতে পেরেছেন, সেটি হচ্ছে মোট মুনাফা এবং নিট মুনাফার অংকের পার্থক্য। আপনি ২২,০০০ টাকা মোট মুনাফা ঠিকই অর্জন করেছিলেন, কিন্তু ব্যবসায়ের অন্যান্য যাবতীয় খরচ মেটানোর পর আপনার হাতে অবশিষ্ট ছিল শুধু ৭,৮০০ টাকা, যা কিনা মোট মুনাফার মাত্র ৩৫%। তাই শুধু মোট মুনাফার পরিমাণ জানা যথেষ্ট নয়।
মালিক বা শেয়ারহোল্ডার পক্ষের কাছে মোট মুনাফা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না, কারণ তারা জানেন যে মোট মুনাফা’ই প্রতিষ্ঠানের আল্টিমেট মুনাফালভ্যতা নিশ্চিত করে না, এই কাজটি করে নিট মুনাফা। প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফাকেই মালিক বা শেয়ারহোল্ডার পক্ষ আল্টিমেট প্রফিট হিসেবে উত্তোলন করতে পারেন।
অপরদিকে মোট মুনাফা শুধু ব্যবসায়ের ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমের ফলাফল প্রকাশ করে। ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম ঠিকভাবে পরিচালিত না হলে মোট মুনাফা কম হয়, চেইন রিয়েকশন হিসেবে নিট মুনাফার পরিমাণও কমে যায়। অপরদিকে, মোট মুনাফা বৃদ্ধি পেলে নিট মুনাফার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
মোট মুনাফা এবং নিট মুনাফার পার্থক্য জানার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ক্রয়-বিক্রয়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ের অন্যান্য কার্যক্রমও সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা জানা। একটি প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা বাবদ বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, ঋণকৃত অর্থের সুদ বহন করতে হয়, করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। তাই ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোও সাবলীলভাবে পরিচালিত হওয়া দরকার। নইলে, মোট মুনাফার পরিমাণ বেশ ভালো হলেও, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য পরিশেষে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
পরিসংহার
ব্যবসায়ের মুনাফালভ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মেট্রিক্স হচ্ছে মোট মুনাফা এবং নিট মুনাফা। মোট মুনাফা বিনিয়োগকারীদের এটা বুঝতে সাহায্য করে যে ব্যবসায়ের মূল কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে কি না। অপরদিকে নিট মুনাফা ব্যবসায়ের অন্যান্য কার্যক্রমের পারদর্শিতা যাচাইয়ে কাজ করে। ইনভেস্টরদের কাছে নিট মুনাফার গুরুত্ব বেশি হলেও, পারতপক্ষে দুটি অনুপাতই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মোট ও নিট মুনাফা একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
- https://www.investopedia.com/ask/answers/101314/what-are-differences-between-gross-profit-and-net-income.asp
- https://www.patriotsoftware.com/blog/accounting/gross-profit-vs-net-profit/
- https://www.creditsafe.com/gb/en/blog/knowledge-base/what-is-the-difference-between-gross-and-net-profit.html
- https://khatabook.com/blog/difference-between-gross-and-net-profit/
- https://www.xero.com/uk/glossary/gross-profit-vs-net-profit/
Next to read
সোশ্যাল ইম্প্যাথি ম্যাপিং (Social Empathy Mapping)


কাস্টমার ডাটা মনেটাইজেশন মডেল (Customer Data Monetization Model)

ফ্রিমিয়াম মডেল (Freemium Model)

লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)

MTNUT কাটিয়ে কিভাবে একটি সেলস ডিল ক্লোজ করবেন?

একমালিকানা ব্যবসা কি এবং কিভাবে বাংলাদেশে একমালিকানা ব্যবসা করা যায়?

ব্যাংক লোন কিভাবে কাজ করে

চাহিদাবিধি (Law of Demand) কী?

হাই পারফমেন্স উদ্যোক্তা (High Performance Entrepreneur)
