চাহিদাবিধি (Law of Demand) কী?

4679
article image

দাম ও চাহিদার মধ্যে যে আপেক্ষিক বা ক্রিয়াগত সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে চাহিদা বিধি বা Law of Demand বলে। সাধারণত কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা হ্রাস পায় এবং দাম কমলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দাম এবং চাহিদার মধ্যকার এই ক্রিয়াগত সম্পর্ক যে বিধির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তাকেই চাহিদা বিধি বলে।

Key Points

  • অর্থনীতির একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চাহিদাবিধি।
  • পণ্যের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি এবং চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি কে কেন্দ্র করেই চাহিদা বিধির ব্যবহার।
  • দাম এবং চাহিদার বিপরীতমুখী সম্পর্ক চাহিদা বিধির মাধ্যমেই প্রকাশ পায়।
  • চাহিদা বিধিতে মূল্য এবং চাহিদা ছাড়া অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত বা স্থির থাকে।
  • চাহিদাবিধি তার শর্ত মেনে চলে, তার শর্তের ব্যতিক্রম হলে সেটি চাহিদা বিধির অন্তর্ভুক্ত হবে না।

"অধ্যাপক মার্শাল এর মতে, অন্যান্য অবস্থা ( যেমন: মানুষের আয়, পণ্যের গুণাগুণ ইত্যাদি ) অপরিবর্তিত থাকলে কোনো পণ্যের দাম কমলে চাহিদা বাড়বে এবং দাম বাড়লে চাহিদা কমবে, এটাই হলো চাহিদাবিধি

অর্থাৎ পণ্যের মূল্য বাড়লে যেমন আমরা ঐ পণ্য ক্রয় করা কমিয়ে দেই আবার মূল্য কমে গেলে পণ্যটি বেশি ভোগ করা শুরু করি, এই অবস্থাকেই চাহিদা বিধি বলে।

চাহিদাবিধি বা Law of Demand

চলুন চাহিদা বিধি বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝে আসি!

রাজু সাহেব গত মাসে ১২০ টাকা কেজি সয়াবিন তেল এবং ১০০ টাকা কেজি আম কিনেছেন। এই মাসে সে বাজারে গিয়ে দেখেন সয়াবিন তেল কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায় এবং আম প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। রাজু সাহেব সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এক কেজির পরিবর্তে আদা কেজি সয়াবিন তেল কিনল এবং আমের দাম হ্রাস পাওয়ায় গত মাসের তুলনায় এক কেজি আম বেশি কিনল। এই যে উদাহরণটিতে রাজু সাহেব সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কম পরিমাণ ক্রয় করল এবং আমের দাম হ্রাস পাওয়ায় আম বেশি পরিমাণে ক্রয় করল এটিই চাহিদা বিধির উদাহরণ।

চাহিদাবিধি এমন একটি অবস্থা নির্দেশ করে, যেখানে পণ্যের মূল্য বা প্রাইস ( P ) বৃদ্ধি পেলে পণ্যের চাহিদার পরিমাণ বা কোয়ান্টিটি ( Q ) হ্রাস পায়। আবার পণ্যের মূল্য বা প্রাইস ( P ) কমলে পণ্যের চাহিদা বা কোয়ান্টিটি ( Q ) বৃদ্ধি পায়।

চাহিদাবিধির শর্তানুযায়ী দাম এবং চাহিদার মধ্যকার সম্পর্ক বিপরীতমুখী। অর্থাৎ চাহিদাবিধিতে দাম ও চাহিদার মধ্যে বিপরীতমুখী বা ঋণাত্মক সম্পর্ক দেখানো হয়।

Law Of Demand বা চাহিদাবিধি তৈরি করেছেন অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল।

যেসব অবস্থায় চাহিদাবিধি হবে না বা চাহিদাবিধির ব্যতিক্রম অবস্থা

১| আয়ের পরিবর্তন:-

ভোক্তার আয়ের পরিবর্তন হলে চাহিদাবিধি কার্যকর হবে না। যেমন: ভোক্তার আয় বৃদ্ধি পেলে কোনো দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও তার চাহিদা কমবে না বরং বৃদ্ধি পাবে, কারণ ভোক্তার অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেশি।

২| রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন:-

ভোক্তার রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটলে চাহিদাবিধি কার্যকর হবে না। যেমন: কেউ যদি ধূমপানের অভ্যাস ছেড়ে দেয় তাহলে সিগারেটের দাম কমে গেলেও তার কাছে এর চাহিদা বাড়বে না।

৩| বিকল্প দ্রব্যের দাম:-

কোনো দ্রব্যের দাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর বিকল্প দ্রব্যগুলোর দামেরও একই হারে পরিবর্তন ঘটে তাহলে চাহিদা বিধিটি কার্যকর হবে না

৪| বিকল্প দ্রব্য নেই:-

যেসব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিকল্প নেই তাদের ক্ষেত্রেও চাহিদাবিধি কার্যকর হয় না। যেমন: লবণ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং এর কোনো বিকল্প দ্রব্য নেই। কাজেই লবণের দাম বাড়লেও এর চাহিদা ভোক্তাদের নিকট কমে না বরং প্রয়োজন অনুযায় বাড়বে।

৫| অবস্থানগত পরিবর্তন:-

পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কোনো সময় দ্রব্যের দাম কমলেও চাহিদা বাড়ে না, তাই এই অবস্থায় চাহিদাবিধি কার্যকর হবে না। যেমন: মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে কুরবানী ঈদের সময় মাছের দাম কমলেও এর চাহিদা বৃদ্ধি পায় না, আবার ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসব গুলোর পূর্বে পোশাকের দাম বৃদ্ধি পেলেও এর চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

৬| ভবিষ্যত দাম:-

কোনো কারণে ক্রেতা বা ভোক্তারা যদি মনে করে ভবিষ্যতে দ্রব্যটির দাম আরো বৃদ্ধি পেতে পারে তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ক্রেতা বা ভোক্তারা ওই দ্রব্যটি অধিক পরিমাণে ক্রয় করবে, তাই এই অবস্থাতায় চাহিদা বিধি কার্যকর হবে না।

৭| ভোক্তার অজ্ঞতা:-

কোনো ভোক্তা যদি দ্রব্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে বা দ্রব্য সম্পর্কে কোন তথ্য না জানার কারণে দ্রব্যের গুণাগুণ বিচার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দাম বৃদ্ধি পেলেও ভোক্তা দ্রব্যটিকে অধিক মূল্যবান মনে করে বেশি পরিমাণে ক্রয় করবে, এইরকম পরিস্থিতিতে চাহিদা বিধি হবে না।

৮| বাজারে ক্রেতার সংখ্যা:-

একটি নির্দিষ্ট বাজারে ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সেখানে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও ক্রেতা বেশি হবার ফলে সেই পণ্যের চাহিদাও বেড়ে যাবে, তাই এখানেও চাহিদা বিধি হবে না।

৯| বাহ্যড়ম্বর পূর্ণ দ্রব্য:-

বাজারে এমন কতিপয় দ্রব্য আছে যেগুলোর দাম বৃদ্ধি পেলে লোকে সামাজিক মর্যাদা বা গৌরব বৃদ্ধির আশায় সেই সব পণ্য বেশি ক্রয় করে থাকে। যেমন: হীরক, মুনিমুক্তা খচিত অলংকার, নতুন মডেলের দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি, সৌখিন বাড়ি এবং জিনিস পত্র প্রভৃতি। অর্থনীতিবিদ ভেবলেন ( Veblen ) এরুপ ভোগকে 'বাহ্যড়ম্বর পূর্ণ ভোগ' বা Conspicuous Consumption হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে চাহিদাবিধি কার্যকর হয় না।

১০| শেয়ার ও দ্রব্যের ফটকা বাজারে লেনদেন:-

শেয়ার বাজারে দেখা যায় শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পেলে তা আরও বৃদ্ধি পাবে এ আশায় ক্রেতারা অধিক সংখ্যক ক্রয় করে। আবার একই ভাবে কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম হ্রাস পেতে থাকলে চাহিদাও হ্রাস পেতে থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে চাহিদাবিধি কার্যকর হয় না।

১১| গিফেন দ্রব্য:-

এমন কিছু নিকৃষ্ট দ্রব্য আছে যেমন: মোটা কাপড়, মোটা চাল, মোটা ডাল, আলু ইত্যাদির ক্ষেত্রে দাম বাড়লে ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং দাম কমলে ক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস পায়। স্যার রবার্ট গিফেন সর্ব প্রথম এসব দ্রব্যের অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন বলে। এগুলোকে 'গিফেন দ্রব্য' (Giffen goods) বলা হয়। গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে চাহিদা বিধির পরিলক্ষিত হয় না বা ব্যতিক্রম দেখা যায়।

চাহিদা বিধির প্রয়োজনীয়তা

অর্থনীতিতে চাহিদা বিধির ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রের সরকারের অর্থনৈতিক বিভিন্ন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে চাহিদা বিধি অনেক বড় অবদান রাখে।

ব্যবসায়ীরা নিকট চাহিদা বিধির প্রয়োজনীয়তা:

চাহিদাবিধি একজন ব্যবসায়ীর পণ্যের দাম নির্ধারণে করতে সহায়তা করে। তারা একটি নির্দিষ্ট স্তরে দাম বৃদ্ধির ফলে চাহিদা কতটা কমে যাবে এবং পণ্যের দাম কমার ফলে চাহিদা কতটা বাড়বে তা বুঝতে পারেন চাহিদাবিধির মাধ্যমে । তাছাড়া বাজারের মোট চাহিদা সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন চাহিদা বিধির মাধ্যমে। চাহিদাবিধি ব্যবস্থাপনাকে পণ্যের দাম কতটা বৃদ্ধি বা হ্রাস করা বাঞ্ছনীয় তা নির্ধারণেও সহায়তা করে থাকে।

সরকারের নিকট চাহিদা বিধির প্রয়োজনীয়তা:

চাহিদা বিধির মাধ্যমে সরকার কোন পণ্যের উপর কি পরিমাণ ট্যাক্স ধার্য করবেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা গ্রহণ করতে পারে। যেসব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে এবং জনগণের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা রয়েছে, কিন্তু মূল্য বৃদ্ধির জন্য চাহিদা কমে যাচ্ছে সেসব পণ্যের ট্যাক্স কমাতে পারে সরকার চাহিদা বিধির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। তাছাড়া যে সমস্ত পণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কেবলমাত্র সেই পণ্যগুলির উপর উচ্চ হারে কর ধার্য করতে পারে।

উপসংহার

চাহিদা বিধি সম্পর্কে সকল ধারণা লাভের পরে বুঝতে পারছেন এটি শুধু ব্যবসায়ী ও নীতি নির্ধারকদের জন্য যে প্রয়োজনীয় তা নয়, এর মাধ্যমে পণ্য মূল্য এবং চাহিদার ধারণা গ্রহণ করে আমাদের বাস্তব জীবনেও বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারি।

  • https://www.investopedia.com/terms/l/lawofdemand.asp
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Law_of_demand
Next to read
Business Models
শেয়ারিং ইকোনমি মডেল (Sharing Economy Model)
শেয়ারিং ইকোনমি মডেল (Sharing Economy Model)

শেয়ারিং ইকোনমি মূলত দুই পক্ষের (Peer to Peer) সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি বিজনেস মডেল, যেখানে মূল প্রতিষ্ঠানটি একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। এক্ষত্রে প্রতিষ্টান গুলো মূলত দুই পক্ষ অর্থাৎ সেবা প্রদানকারী এবং সেবা গ্রহণকারীদের মাঝে প্রযুক্তির সহায়তায় নিজস্ব কৌশলে সংযোগ করে দেয়।

বি-টু-বি, বি-টু-সি এবং বি-টু-জি কি? (B-to-B, B-to-C, B-to-G)
Business
বি-টু-বি, বি-টু-সি এবং বি-টু-জি কি? (B-to-B, B-to-C, B-to-G)
লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)
Logo
লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)
ইক্যুইটির সংজ্ঞা এবং অর্থ
Business
ইক্যুইটির সংজ্ঞা এবং অর্থ
অর্থনীতি কী?
Economics
অর্থনীতি কী?
বিনিয়োগ কি? বিনিয়োগের ধরণ এবং উদাহরণ
Investment
বিনিয়োগ কি? বিনিয়োগের ধরণ এবং উদাহরণ
ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন
Business Law
ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন
ডিমার্কেটিং (DeMarketing)
Marketing
ডিমার্কেটিং (DeMarketing)
বিক্রয় বৃদ্ধি করার ৬টি নীতি
Sales
বিক্রয় বৃদ্ধি করার ৬টি নীতি
Generally Accepted Accounting Principle (GAAP)
Accounting
Generally Accepted Accounting Principle (GAAP)