সামষ্টিক অর্থনীতি বা ম্যাক্রো ইকোমিক্স ( Macro Economics ) কী?

অর্থশাস্ত্রের যে অংশে সামগ্রিক বা জাতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক আচরণ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় তাকে সামষ্টিক অর্থনীতি বা Macro Economics বলে। অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতিতে পৃথক পরিমাণের পরিবর্তে সমষ্টিগত পরিমাণ, ব্যক্তিগত আয়ের পরিবর্তে জাতীয় আয়, নির্দিষ্ট দ্রব্যের দামের পরিবর্তে সাধারণ দামস্তর এবং ব্যক্তিগত উৎপাদনের পরিবর্তে জাতীয় উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
Key Points
- সামষ্টিক অর্থনীতি সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির আচরণের পর্যালোচনা। এটি একটি জাতির উৎপাদন, নিয়োগ, এবং মূল্যের সামগ্রিক স্তর নিয়ে বিশ্লেষণ করে
- সামষ্টিক অর্থনীতি ক্ষুদ্রাংশের নয়, বরং পূর্ণায়বয়রের আলোচনা
- দীর্ঘমেয়াদি এবং বৃহৎ অর্থনীতি আলোচিত হয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে
- সামষ্টিক অর্থনীতি আয়ের সুষম বন্টন করতে এবং মুল্যস্তর স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে
- বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সামষ্টিক অর্থনীতি কাজ করে থাকে
সামষ্টিক অর্থনীতি হচ্ছে অর্থনীতির একটি শাখা, যা সমগ্র অর্থনীতি নিয়ে পর্যালোচনা করে। বিনিয়োগ, মূদ্রস্ফীতি, বেকারত্ব, মোট যোগান, মোট চাহিদাসহ বড় বড় অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করে।
যেমন ধরুন কোন একজন ব্যবসায়ী যদি তার এই অর্থ বছরে কি পরিমাণে পণ্য উৎপাদিত হয়েছে, তা থেকে কি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে এবং লভ্যাংশের পরিমাণ কত ইত্যাদি হিসেব নিকেশ করে বা ভুল-ত্রুটি উদঘাটনের জন্য যদি বিচার বিশ্লেষণ করে, তাহলে সেটা কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং পুরো দেশে এক অর্থ বছরে কি পরিমাণ দেশীয় পণ্য উৎপাদিত হয়েছে এবং সেখান থেকে কি পরিমাণ সরকারের আয় হয়েছে তা বিচার বিশ্লেষণ করলে তখন সেটা সামষ্টিক অর্থনীতির আওতায় আসবে।
সামষ্টিক অর্থনীতি বা Macro Economics কথাটি ১৯৩৩ সালে ওসলো ( Oslo ) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Rangner Frisch সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। Macro শব্দটি গ্রিক Makros শব্দ থেকে এসেছে, যার শব্দগত অর্থ বৃহৎ বা বিশাল।
সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বর্তমান সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাপক। সামষ্টিক অর্থনীতি দেশের অর্থ ব্যবস্থার সার্বিক খাত নিয়ে কাজ করে। নিচে সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলো আলোচনা করা হলো।
১. অর্থনৈতিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করা:
আধুনিক যুগে সরকার অর্থের যোগান বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করে। যেমন করোনার সময় অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদন, ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এই সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম সামষ্টিক অর্থনীতির মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, তাই বলা যায় সামষ্টিক অর্থনীতি তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে।
২. মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা:
সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার বড় দুইটি বাঁধা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং বেকারত্বের হার প্রতিনিয়ত কমিয়ে আনা।
৩. জিএনপি বা GNP ( Gross National Product ) সর্বোচ্চ করা:
একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণ একবছরে) একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে যে চুড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা হয়, তার বাজার মূল্যের সমষ্টিকে জিএনপি বলে। জিএনপি একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরে। যে দেশে জিএনপি এর আকার যত বড় সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জিএনপি এর সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা এবং জিএনপি এর গ্যাপ কমিয়ে এনে সর্বোচ্চ জিএনপি অর্জনের পথ নির্দেশ করে দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা।
৪. সামষ্টিক চলকসমূহের ভারসাম্য বজায় রাখা:
সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণে বিভিন্ন চলকের ভারসাম্য মান বের করা। যেমন ভারসাম্য জাতীয় আয় স্তর, ভারসাম্য ভোগ স্তর, ভারসাম্য সঞ্চয়, ভারসাম্য বিনিয়োগ, ভারসাম্য কর্মসংস্থান, ভারসাম্য দামস্তর, ভারসাম্য সুদের হার, ভারসাম্য সরকারি ব্যয়, ভারসাম্য নীট রপ্তানি ইত্যাদির নির্ণয় করা এবং ভারসাম্য রক্ষা করা।
৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টি:
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে বেকারত্ব রোধ করা সম্ভব নয়। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে; কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তরাণ্বিত করার উপায় খুঁজে দেয়া। বেকারত্বকে বলা হয় অপূর্ণ বিনিয়োগ এই অপূর্ণ বিনিয়োগকে পূর্ণ বিনিয়োগে রুপান্তরের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আয়স্তর বৃদ্ধিও সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর অন্তর্ভুক্ত।
সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা!
অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা অর্থনীতিবিদ ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানের সকল শাখার সাথে জড়িত ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির ধারণা থাকা দরকার। তাছাড়া সমাজ চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, নীতি নির্ধারক, ব্যাংকার, গবেষক ও পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের নিকট সামষ্টিক অর্থনীতির পাঠ এবং এ বিষয় প্রাথমিক জ্ঞান থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা এবং সমাধানের ব্যাপারে সামষ্টিক অর্থনীতি শুধু অর্থবহ নয় তা গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
নিচে সামষ্টিক অর্থনীতির বহুমুখী গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।
১. ব্যষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণে:
সামষ্টিক অর্থনীতি এমন একটি অর্থনীতি যে অর্থনীতি সম্পর্কে না জানলে, ব্যক্তিক অর্থনীতি সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। প্রায় অর্থনীতিবিদই স্বীকার করেছেন, সমষ্টিগত দিক পূর্বে বিবেচনা না করে ব্যক্তিগত অর্থনীতির কোন বিধিকে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। তা যদি কখনও প্রণয়ন করা হয় তাহলে তা অসম্পূর্ণতার দোষে ও বাস্তব না হওয়ার দোষে দুষ্ট। ব্যক্তিক অর্থনীতি পূর্ণ বিশ্লেষণের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি জানা প্রয়োজন।
২. অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে:
বর্তমান কালে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অবসানের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্পর্কযুক্ত আর্থিক নীতি ও রাজস্বনীতির প্রয়োগে সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্ব অসীম। দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার যে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন তার পিছনে সমষ্টিগত অর্থনীতির ভূমিকা সহজেই চোখে পড়ে।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্লেষণে সামষ্টিক অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের সম্পদকে তথা তথ্য, শ্রম ও মূলধনকে কিভাবে সঠিক উপায়ে নিয়োগ করা যায়, জীবনযাত্রার মান কিভাবে উন্নত করা যায় ও দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের সমন্বয়ে কিভাবে উন্নয়ন করা যায় এসব প্রশ্নের উত্তর কেবলমাত্র সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমেই পাওয়া যায়।
৪. বাণিজ্যিক চক্র:
সময়ের সাথে সম্পর্ক রেখে দেশের উৎপাদন, আয়, নিয়োগ, দামস্তর ইত্যাদি উঠা-নামা করে। তাই বাণিজ্যিক চক্রে সমৃদ্ধি ও মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সমৃদ্ধি ও মন্দাভাব এর সাথে সমস্যা দেখা দেয়। কাজেই বাণিজ্যিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করা তথা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা খুবই জরুরি। সামষ্টিক অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পক্ষে বাণিজ্যিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
৫. অর্থনৈতিক অবস্থার উত্থান-পতন:
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা নিত্য দিনের সাথী। আর সামষ্টিক অর্থনীতি এই অস্থিরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারে। কেননা সামগ্রিক ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় দ্বারা দেশের আয়, উৎপাদন ও নিয়োগ সম্পর্কিত অস্থিরতা ব্যাখ্যা করা যায়। সামষ্টিক অর্থনীতির মাধ্যমে নীতি প্রণয়নের আলোকে এই অস্থিরতা অনেকটা নিরসন করা যায়।
৬. দেশের জাতীয় আয়ের সমীক্ষা:
কোন দেশের জাতীয় আয় ঐ দেশের পরিচয়ের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। কোন দেশের জাতীয় আয়ের সমীক্ষা দ্বারা নির্ণীত হয় দেশটি উন্নত না অনুন্নত। সামষ্টিক অর্থনীতির দ্বারা জাতীয় আয়ের সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি জাতীয় আয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠে। এই অবস্থায় সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. আর্থিক ও রাজস্বনীতি:
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে আধুনিক কালে রাজস্বনীতি এবং আর্থিক নীতি প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এসব নীতিমালা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে না পারলে তথা নীতিমালা গ্রহণ ও প্রয়োগে ভুল থাকলে তা সুফলের পরিবর্তে কুফল ডেকে আনবে। সমস্যাকে আরো গভীর থেকে গভীরতর করে। কাজেই আর্থিক ও রাজস্বনীতি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা লাভ করতে হলে সামষ্টিক অর্থনীতির কোন বিকল্প নেই।
৮. সরকারি নীতি নির্ধারণে:
দেশের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, প্রশাসনিক অযোগ্যতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব তাই এসব দেশের সরকার ও সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের উপর বর্তায়। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এসব দেশের উন্নয়ন সম্ভব। তাই উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলের সামষ্টিক অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সামষ্টিক অর্থনীতি একজন ছাত্রছাত্রী তথা একজন পাঠককে সমগ্র অর্থনীতির সমস্যা সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে। তা সমাধানের পথনির্দেশ করতে হলে সামষ্টিক অর্থনীতি পাঠ করা খুবই দরকার।
উপসংহার
সামষ্টিক অর্থনীতি যেহেতু দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে থাকে, তাই সাধারণ মানুষ হিসেবে অর্থনীতির সমন্ধে বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতি সমন্ধে জ্ঞান থাকলে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে ব্যক্তিগত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, যা ব্যক্তিক এবং রাষ্ট্রীয় মঙ্গল বয়ে আনবে।
- মূল আর্টিকেল সোর্স: ম্যাক্রো ইকোনমিক্স বই।
Next to read
মার্কেটিং এর ৭'পি (7P’s of Marketing)


ডিজিটাল মার্কেটিং কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ? ডিজিটাল মার্কেটিং এর ক্ষেত্রসমূহ

Needs, Wants, Demands (প্রয়োজন, চাওয়া এবং চাহিদা)

রেড ওশান এবং ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি (Red Ocean & Blue Ocean Strategy with Example

লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)

নিট মুনাফা (net profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং কিভাবে হিসাব করবেন

CSR বা Corporate Social Responsibility কী?

সেলস টার্গেট অর্জনের জন্য ১০টি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিপস

ব্র্যান্ড আর্কিটেকচার কী? সংজ্ঞা, মডেল এবং উদাহরণ
