বিক্রয়ের ১০টি ভুল যেগুলো প্রতিটি বিক্রয়কর্মীর এড়ানো উচিৎ

সেলস ক্যারিয়ারে মোটামুটি সকল বিক্রয়কর্মীই কিছু কমন ভুল করে থাকেন। যেমন - কম শোনা এবং বেশি কথা বলা অথবা সঠিক সমাধানের দিকে ফোকাস না করা ইত্যাদি। কমন ভুলগুলো একবার জেনে নিলে পরবর্তীতে আপনিও এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারবেন এবং উপযুক্ত টেকনিক অবলম্বন করতে পারবেন।
Key Points
- বর্তমান সময়ের ক্রেতাগণ মূল্যের পাশাপাশি পণ্যের ভ্যালুর উপরেও সমান গুরুত্ব আরোপ করেন।
- পণ্যের মূল্যের মার্কেটিং বেশি না করে বরং পণ্যটি ক্রেতাদের জীবনে ঠিক কি পরিমাণ ভ্যালু যোগ করবে সেটির মার্কেটিং করা উচিৎ।
- বর্তমান সময়ের ক্রেতাগণ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা এবং প্রয়োজনের জন্য কাস্টমাইজড পণ্য বা সেবা বেশি প্রিফার করেন।
- আপনার পণ্য প্রয়োজন নয় এমন মানুষের কাছে যদি আপনি মার্কেটিং শুরু করেন তাহলে তারা বিরক্ত হবে এবং আপনার সময়ও নষ্ট হবে।
বিক্রয়ের ১০টি ভুল যেগুলো প্রতিটি বিক্রয়কর্মীর এড়ানো উচিৎ
বিক্রয় করা হচ্ছে একধরণের শিল্প। একজন সফল বিক্রয়কর্মী হতে ট্যালেন্ট এবং স্কিল দুটোই প্রয়োজন। ট্যালেন্টের মাধ্যমে বিক্রয়কর্মীরা অনুমান করতে পারেন যে কোন পরিস্থিতিতে কোন ধরণের কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি ইফেক্টিভ হবে এবং দীর্ঘ সময় এই ফিল্ডে কাজ করার ফলে বিক্রয়কর্মীরা বিভিন্ন ধরণের স্কিল অর্জন করে ফেলেন যেগুলো তাদের বিক্রয়ের হার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য যেকোনো কাজের মতো, বিক্রয়ের কাজেও প্রয়োজন দীর্ঘ প্র্যাক্টিস, ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা, বারংবার ভুল করা এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার মনোভাব।
তাই সেলস ক্যারিয়ারের শুরুতে অথবা মধ্যবর্তী যেকোনো পর্যায়ে সেলসপারসনরা কিছু কমন ভুলের সম্মুখীন হয়ে থাকেন যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য হুমকিস্বরুপ হয়ে দেখা দিতে পারে। আজকের লেখায় আমরা এমনই কিছু ভুল তুলে ধরেছি আপনার জন্য যাতে আপনি এগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন।
১. পণ্যের ভ্যালুর চাইতে দামের উপর বেশি জোড় দেয়া
বিক্রয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিক্রয়কর্মীরা সবচেয়ে কম মূল্যে পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা করেন এবং সেটারই মার্কেটিং সবচেয়ে বেশি করেন। যদিও ক্রেতার বিবেচনায় পণ্যের মূল্য একটি বড় ফ্যাক্টর, তবে বর্তমান সময়ের ক্রেতাগণ মূল্যের পাশাপাশি পণ্যের ভ্যালুর উপরেও সমান গুরুত্ব আরোপ করেন। যেই পণ্যটি তার জীবনে তুলনামূলক বেশি ভ্যালু যোগ করে সেটি একটু বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করতেও তার বাধে না। তাই পণ্যের মূল্যের মার্কেটিং বেশি না করে বরং পণ্যটি ক্রেতাদের জীবনে ঠিক কি পরিমাণ ভ্যালু যোগ করবে সেটির মার্কেটিং করুন।
অন্যদিকে, দামের উপর বেশি জোড় দেয়ার আরো একটি সমস্যা হচ্ছে, এর মাধ্যমে আপনি কিছু ওয়ান-টাইম কাস্টমার পাবেন যারা দীর্ঘমেয়াদে আপনার থেকে পণ্য ক্রয় করবে না। যে মূহুর্তে অন্য কেউ আপনার থেকেও কম প্রাইসে পণ্য অফার করবে টিক তখনই তারা আপনার থেকে পণ্য না কিনে অপর ব্যক্তির থেকে কিনবেন। তাই এই ভুলটি এড়িয়ে চলতে হবে।
২. কম শোনা এবং বেশি কথা বলা
কোনো কিছু বিক্রয় করতে চাইলে বিক্রয়কর্মীরা উক্ত পণ্য বা সেবাটির সুবিধাসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে এতো বেশি কথা বলে ফেলেন যে ক্রেতার কথা শোনার সময়ই তাদের হয়ে ওঠে না। এই পদ্ধতি গত শতাব্দীতে বেশ কার্যকর হলেও, বর্তমান সময়ে আর এভাবে বিক্রয় বৃদ্ধি করা যায় না। বর্তমান সময়ের ক্রেতাগণ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা এবং প্রয়োজনের জন্য কাস্টমাইজড পণ্য বা সেবা বেশি প্রিফার করেন। এমতাবস্থায় আপনিই যদি বেশি সময় কথা বলেন তাহলে ক্রেতার প্রিফারেন্স জানার সময়টিই আপনার হবে না।
তাই আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি কথা বলা শুরু করার আগে ক্রেতার সমস্যা বা প্রয়োজন সম্পর্কে বিস্তারিত শুনছেন। একবার ক্রেতা তার প্রয়োজন আপনাকে বুঝিয়ে বলার পর আপনি সেই অনুযায়ী তাকে পণ্য বা সেবা অফার করতে পারেন। আপনার কথা শোনা এবং কথা বলার অনুপাত অবশ্যই ৬০ঃ৪০ এর বেশি হওয়া যাবে না।
৩. সুবিধাসমূহ বাড়িয়ে বলা
ক্রেতাদের আগ্রহী করে তুলতে বিক্রয়কর্মীরা হরহামেশাই পণ্যের সুবিধাগুলো বাড়িয়ে বলেন। এর মাধ্যমে আপনি শর্টটাইমে বিক্রয় করতে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে অনেক ক্রেতা হারাবেন। কারণ, একবার পণ্য ক্রয় করার ক্রেতা যদি আপনার কথার সাথে কাজের মিল না পান তাহলে তিনি আর আপনার কাছে আসবেন না এবং এটাই স্বাভাবিক। তাই পণ্যের সুবিধা সম্পর্কে বাড়িয়ে না বলে, ঠিক যথাযথ সুবিধাগুলোই ব্যাখ্যা করা উচিত।
৪. সঠিক সমাধানের দিকে ফোকাস না করা
অধিকাংশ সময় বিক্রয়কর্মীরা পণ্যের অতিরিক্ত সুবিধাসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে মূল সুবিধাটির কথাই ভুলে যান, এটি একটি বড় ভুল। আপনার পণ্যে হয়তো আরো অনেক অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো ব্যাখ্যা করার পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। বরং সেই সমাধানটির দিকেই বেশি ফোকাস করা উচিত যেটি আপনার ক্রেতা খুজে চলেছেন। আর অতিরিক্ত সুবিধাসমূহ শোনার পর অধিকাংশ ক্রেতাই আরো বেশি আগ্রহী হওয়ার বদলে আরো বেশি কনফিউজড হয়ে পরেন। তাই এই ভুলটি এড়াতে হবে।
উদাহরণস্বরুপ - আপনি একজন মোবাইল ফোন বিক্রেতা। এখন আপনার দোকানে এমন একজন অভিভাবক এসেছেন যিনি তার সন্তানের অনলাইন ক্লাসের জন্য একটি মোবাইল কিনতে চাচ্ছেন। তিনি একটি মডেল সিলেক্ট করার পর আপনার কাজ হবে সেই মডেল দিয়ে আদৌ ভালোভাবে অনলাইন ক্লাস করা যায় কি না সেটা ব্যাখ্যা করার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করা। যেমন - মডেলটির নেটওয়ার্ক আইসি বেশ ভালোমানের তাই অনলাইনে ক্লাস করার সময় নেটওয়ার্কের ঝামেলা হবে না অথবা মডেলটির স্ক্রিন সাইজ বড়, তাই সহজেই বোর্ডের লেখা মোবাইলের স্ক্রিনে বোঝা যাবে ইত্যাদি। এগুলো না করে আপনি যদি মোবাইলটির গেমিং চিপসেট, হাই পারফর্মিং ক্যামেরা, লাইটনিং ফাস্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইত্যাদি সুবিধা ব্যাখা করতে লেগে পরেন তাহলে সেটি হবে এক বড় ভুল।
৫. সম্ভাব্য ক্রেতাদের সাথে তর্কে জড়ানো
একজন বিক্রয়কর্মীকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ মানুষের সাথে কথা বলতে হয় এবং প্রায় প্রতিটি মানুষই ভিন্ন ভিন্ন আচরণ নিয়ে বিক্রয়কর্মীদের সামনে আসেন। অনেকসময় ক্রেতা অযৌক্তিক কোনো কথা বলে ফেললে তার সাথে তর্কে জড়িয়ে পরা অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে বিক্রয়কর্মীদের উচিৎ এই পরিস্থিতি যেকোনো উপায়ে এড়িয়ে চলা। কোনো সম্ভাব্য ক্রেতা যদি অযৌক্তিক কোনো আবদার করেই ফেলেন, তাহলে আপনার উচিৎ নিজের প্রফেশনালিজম মেইনটেইন করে সেটি পোলাইটলি নাকচ করা। তার সাথে অযথা তর্কে জড়িয়ে পরার কোনো মানে হয়। সেই সময়টা অন্য এক ক্রেতার পেছনে দিলেও হয়তো আপনার আরো একটি পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা যাবে।
৬. সবার কাছে সবধরণের পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন
বিক্রয়কর্মীরা নিজেদের পারদর্শিতা দেখাতে গিয়ে যেকোনো ধরণের ক্রেতার নিকট পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা করেন। এই কাজটি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একমাত্র তাদের কাছেই আপনার পণ্য বিক্রয় করার চেষ্টা করুন, যাদের আপনার পণ্যটি প্রয়োজন। আপনার পণ্য প্রয়োজন নয় এমন মানুষের কাছে যদি আপনি মার্কেটিং শুরু করেন তাহলে তারা বিরক্ত হবে এবং আপনার সময়ও নষ্ট হবে। তাই এই কাজ করে সময় নষ্ট না করে অধিক সম্ভাব্য ক্রেতাদেরকেই পিচ করুন এবং বিক্রয়ের হার বৃদ্ধি করুন।
৭. খুব অল্পের বিনিময়ে অনেক বেশি অফার করা
বিক্রয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিক্রয়কর্মীরা ক্রেতাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করে। কারণ, ক্রেতার যেখান থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন সেখান থেকেই তার পণ্য বা সেবা নিবেন। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তির চাইতে সুবিধা প্রদানের হার অনেক বেশি হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে ক্রেতা’ও খামখেয়ালি করা শুরু করেন কারণ তিনি খুব অল্পের বিনিময়ে অনেক বেশি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন যা তিনি আশা করেননি। আবার এতে করে পণ্য বা সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
অনেকসময় ক্রেতারা কিছু না কেনা সত্ত্বেও পণ্য বা সেবা সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য নিয়ে থাকেন বিক্রয়কর্মীদের থেকে। একজন ক্রেতার পেছনে এতোটা সময় ব্যয় করার পরেও বিক্রয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অথচ, এই সময়টা আরো একজন সম্ভাব্য ক্রেতার পেছনে ব্যয় করলেও হয়তো একটি বিক্রয় নিশ্চিত হতো। তাই, সর্বদা চেষ্টা করবেন যাতে আপনার প্রাপ্তি এবং সুবিধা প্রদানের হার ঠিক থাকে।
৮. ক্রেতা সম্পর্কে আগে থেকে রিসার্চ না করা
রিটেইল মার্কেটে এটি বিশেষ বড় ব্যাপার না হলেও বিটুবি মার্কেটে এটি একটি বড় সমস্যা। বিটুবি মার্কেটে যেহেতু হাই ভলিউমে ও হাই এমাউন্টে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তাই এখানে ক্রেতারা অনেক বেশি রিসার্চ ও ভ্যালু ওরিয়েন্টেড সেলস পিচ আশা করে থাকেন। সেটি করতে ব্যর্থ হলে ক্রেতারা সাধারণত অর্ডার করা থেকে বিরত থাকেন। তাই, আপনার সেলস পিচকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তুলতে অবশ্যই আগে থেকে ক্রেতা সম্পর্কে রিসার্চ করুন। ক্রেতার পছন্দ-অপছন্দ, প্রিফারেন্স, সমস্যা এবং প্রয়োজন সম্পর্কে যথেষ্ট রিসার্চ করে একমাত্র তারপরেই প্রেজেন্টেশন তৈরি করা উচিত।
৯. ক্রেতার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন
অধিকাংশ বিক্রয়কর্মী একবার পণ্য বিক্রয় করার পর আর ক্রেতার সাথে যোগাযোগ রাখেন না। এর মাধ্যমে কিন্তু ক্রেতার অন্য কোনো পণ্যের দিকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অন্যদিকে আপনি যদি ক্রেতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তাহলে তিনি আগামীবারও আপনার থেকে পণ্য ক্রয় করবেন সেই সম্ভাবনাই বেশি। তাই এই কাজটি করার মাধ্যমে আপনি রিটার্নিং কাস্টমারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবেন।
১০. এগ্রেসিভ মার্কেটিং করা
ক্রেতা আপনার কাছে আসলে প্রথমেই তার সমস্যাটি এবং প্রয়োজন সম্পর্কে আপনাকে ভালোভাবে শুতে নিতে হবে। তার প্রয়োজন সম্পর্কে না জেনেই যদি আপনি সবচেয়ে বেশি মূল্যের পণ্যটি তাকে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলে সেটি হয়ে পরে খুবই এগ্রেসিভ এবং আনপ্রফেশনাল। তাই, ক্রেতাকে আপনার কাছে থাকা এমন সব পণ্য’ই সাজেস্ট করুন যেগুলো তার সমস্যাটির সমাধান করতে পারবে। এরপর ক্রেতা নিজে থেকেই তার পছন্দের পণ্যটি বাছাই করে নিতে পারবেন।
পরিসংহার
আপনি যেই ব্যবসা’ই করুন না কেনো, বিক্রয় আপনাকে করতেই হবে, হোক সেটি কোনো পণ্য অথবা সেবা। তাই ভুলগুলো শুধরে যতো দ্রুত সম্ভব স্কিলড হয়ে উঠেবন সেটি আপনার ব্যবসায়ের জন্য ততো বেশি মঙ্গলকর হবে। খুশির কথা হচ্ছে, যে কেউ চাইলেই দীর্ঘসময় অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একজন আদর্শ সেলসপার্সন হয়ে উঠতে পারেন।
- https://www.dummies.com/article/business-careers-money/business/sales/the-10-biggest-sales-mistakes-to-avoid-144024/
- https://www.linkedin.com/pulse/top-10-sales-mistakes-how-avoid-them-peter-turley?trk=public_profile_article_view
- https://salesinsightslab.com/sales-mistakes/
- https://www.entrepreneur.com/article/242296
Next to read
সোশ্যাল বিজনেস মডেল ক্যানভাস (Social Business Model Canvas)


কাস্টমার ডাটা মনেটাইজেশন মডেল (Customer Data Monetization Model)

বেইট এন্ড হুক মডেল (Bait & Hook Model)

সাবস্ক্রিপশন মডেল (Subscription Model)

রেড ওশান এবং ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি (Red Ocean & Blue Ocean Strategy with Example

নিট মুনাফা (net profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং কিভাবে হিসাব করবেন

ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন

ডিমার্কেটিং (DeMarketing)

সেলস এবং মার্কেটিং কিভাবে একসাথে কাজ করে
